চিকিত্সা সেবার অগ্রগতিতে বাধা রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি

স্টাফ রিপোর্টার: চিকিত্সা সেবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। বিশ্বের অত্যাধুনিক নিউরো সাইন্স হাসপাতাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউট ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটেও আন্তর্জাতিক মানের চিকিত্সা সেবা দেয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের ডাক্তার ও নার্সরা এখানে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। মেডিকেল শিক্ষার গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। তবে চিকিত্সা বিজ্ঞানে আরও অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিত্সকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়া। আর এই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে হাসপাতালগুলোতে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। সরকারি হাসপাতালে স্বাচিপ, বিএমএ’র নামে এক শ্রেণির চিকিত্সকদের মধ্যে চলছে চরম দলাদলি। আর এই দলাদলির কারণে তদবির করে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। ১০জন বিশেষজ্ঞ বলছেন, বাংলাদেশে চিকিত্সকদের যে দলাদলি চলে, এমনটি পৃথিবীর কোথাও ঘটে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে চিকিত্সকরা চিকিত্সা সেবা ও শিক্ষার মান আরও এগিয়ে নেয়ার প্রতিযোগিতা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে চলছে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। চিকিত্সা বিজ্ঞানে জৈষ্ঠতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে প্রধান্য দিতে হয়। কিন্তু দলাদলির কারণে বাংলাদেশে সেটাও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তাই দলীয় বিবেচনায় অযোগ্যরাই গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেয়। এটাও চিকিত্সা সেবার মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। দলীয় লেজুড়ভিত্তির কারণে চিকিত্সকদের দলাদলি ও ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুধু এই সরকারের আমলে নয়, বিএনপিসহ চার দলীয় জোট সরকারসহ বিগত সরকারের আমলেও ছিলো।
চিকিত্সা বিজ্ঞানে আরও অগ্রগতি অর্জনে সরকার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিকিত্সা বিজ্ঞানের উন্নতি কীভাবে করা যায় তা নিয়ে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রতিটি বিভাগে একটি করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে তার সরকারি সফরকালে সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় শেখ হাসিনা সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, ‘আপনার দেশে চিকিত্সা সেবা এত উন্নত করা কীভাবে সম্ভব হলো। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমও চিকিত্সা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তিনি এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণের পরই বলেন, চিকিত্সা সেবা নিয়ে রাজনীতি করা যাবে না। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চিকিত্সকদের মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকতে হবে। কেউ রাজনীতি করতে চাইলে প্রতিষ্ঠানে নয়, বাইরে গিয়ে রাজনীতি করতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা মানের একটি নীতিমালা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সবকিছু নিয়ম নীতির মধ্যে নিয়ে আসা হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও রাজধানীর ৮টি সরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ এবং ৮টি জেলার সদর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সিভিল সার্জন জানান, হাসপাতালগুলোতে এক শ্রেণির চিকিত্সকদের মধ্যে চলছে চরম দলাদলি। এ দলাদলির কারণে চিকিত্সা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এ কারণে প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক চিকিত্সা সেবার মান উন্নয়নে বড় বাধাঁ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে অনেক চিকিত্সক চিকিত্সা শিক্ষা ভুলতে বসেছেন। এ অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই, বাঁচতে চাই। তবে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য চিকিত্সকদের দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখতে হবে।
এদিকে চিকিত্সা সেবার ক্ষেত্রে ভুল সারাবিশ্বেই হয়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশ এখন চিকিত্সা সেবায় আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। সম্প্রতি নেপালে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত কবির হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ও বার্ন ইউনিটে চিকিত্সা সেবা দেয়া হচ্ছিলো। ইনফেকশনের কারণে তার এক পা কাটার পরামর্শ দিয়েছিলেন এই ইউনিটের বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা। তবে পরিবার মানতে নারাজ। অভিভাবকরা কবির হোসেনকে বিশেষ ব্যবস্থায় দ্রুত সিঙ্গাপুর নিয়ে যান। সিঙ্গাপুরের চিকিত্সকরা পর দিনই তার ডান পা হাঁটু পর্যন্ত কেটে ফেলেছেন।
সেখানকার বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা তার অভিভাবকদের জানিয়ে দেন, পা না কাটলে তার সুস্থ হওয়ার কোনো সম্ভবনা নেই। একই কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের চিকিত্সকরা। সিঙ্গাপুরের চিকিত্সকরা ঢামেকের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামান্ত লাল সেনের কাছে মুঠোফোনে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে বলেন, ডা. সেন, আপনার চিকিত্সকদের পরামর্শই সঠিক ছিলো। এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেমন গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মজিবুর রহমান ভুঁইয়া সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে অপারেশন টেবিলে মারা যান। মুক্তামনির হাতের টিউমার অপারেশনে সিঙ্গাপুরের চিকিত্সকরা অপারগতা জানান। একইভাবে জোড়া শিশু তোফা-তহুরার ক্ষেত্রে একই অভিমত ব্যক্ত করেন সেখানকার চিকিত্সকরা। এই দুটি ঝুকিঁপূর্ণ অপারেশনও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সফলভাবে সম্পন্ন হয়। তারা এখন সুস্থ রয়েছে।
মেডিসিনের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, গ্যাস্ট্রো এন্ট্রোলজি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হাসান, নাক, কান ও গলার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত, নিউরোলজির অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদ, হূদ রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সজল ব্যানার্জি, কিডনির অধ্যাপক হারুনসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক মান সম্পন্ন চিকিত্সক বাংলাদেশে রয়েছেন। তবে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির পাশাপাশি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনা বিরাজ করছে। দেশের অধিকাংশ বেসরকারি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঠিক হয় না। একই পরীক্ষার রিপোর্ট একেক ডায়গনেস্টিক সেন্টারে ভিন্নধর্মী। এধরনের প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের কারণে রোগীরা ভুল চিকিত্সার শিকার হয়। ক্লিনিক কিংবা ডায়গনস্টিক সেন্টারের মালিকরা সেবার মানের চেয়ে আর্তিক লাভের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। নিম্ন মানের রি-এজেন্ট ও যন্ত্রপাতি পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ কারণে এই বেসরকারি ডায়গনেস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টে ভুলের ছড়াছড়ি। বেসরকারি অনেক নামিদামি হাসপাতালেও মেয়াদ উর্ত্তীণ ওষুধ ও নিম্নমানের রি-এজেন্ট ব্যবহার করায় সেখানেও চিকিত্সা সেবার মান নিয়ে বিতর্ক। ভুল চিকিত্সা ও প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। প্রায়ই ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। ওই সব নামিদামি হাসপাতালে দু’জন চিকিত্সক ইত্তেফাক’কে জানান, এসব নামিদামি হাসপাতালে চাকচিক্যময় সৌন্দর্য থাকলেও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে অনেক। কর্তৃপক্ষ সেবার মানের চেয়ে লাভবান হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
বেসরকারি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। এছাড়া বেঙের ছাতার মতো রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত যেসব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়গনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে, এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিত্সা সেবা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে নিম্নমানের অব্যবস্থাপনা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। এসব প্রতিষ্ঠানে চিকিত্সা সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে, নইলে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে বলে বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা জানান। শুধু তাই নয়, মনিটরিং না থাকায় বেসরকারি অনেক নামিদামি হাসপাতালেও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও অব্যবস্থাপনা ধরা পড়ছে।
এদিকে ওষুধের মান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। বিদেশে যেসব ওষুধ রপ্তানি করা হয়, তার গুণগত মান একশত ভাগ থাকে। আর দেশে বাজারজাতকৃত ওষুধের মান আরেক রকম। আবার ঢাকার ওষুধের থেকে বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের ওষুধের গুণগত মান আরও নিম্নমানের। মাঝে মাঝে ঢাকার বাহিরের ওষুধে আটা-ময়দার গুঁড়া থাকার বিষয়টি মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে। ভ্রাম্যমাণ আদালত অনেক সময় জেল জরিমানা করে থাকে। এমন হচ্ছে যে, চিকিত্সক ওষুধ দিয়েছে, সে ওষুধে কোন কাজ হচ্ছে না। তবে ওই চিকিত্সক একই ওষুধ অন্য কোম্পানির দিলে কাজ হচ্ছে। বাহিরের ওষুধ দিলে রোগী ভালো হয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে মাঝে মাঝে রোগীদের সাথে চিকিত্সকদের ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। প্রায় সময় অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটে থাকে।
দেশের একমাত্র মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিত্সা সেবার মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উন্নীত হলেও সেখানে আছে দলাদলি ও গ্রুপিং। আর এসব কারণে সেখানে চিকিত্সা সেবা, শিক্ষা ও গবেষণার কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কারণে চিকিত্সকদের মেধা ও মননের বিকাশ অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এক শ্রেণির চিকিত্সক নিয়োগ, বদলি, বাণিজ্য, দলাদলি আর গ্রুপিং নিয়েও ব্যস্ত থাকায়। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে অধিদপ্তর, স্থানীয় হাসপাতাল, জেলা সদর হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনগণ তিক্ত-বিরক্ত হচ্ছেন। সেখানে প্রশাসনিক কার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। এমন সত্যতা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। এদিকে র্যা বের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সারওয়ার আলম ১২৫টি হাসপাতালে মোবাইলকোর্ট পরিচালনা করেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নামিদামি বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে। মোট ৩৪ জনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ওই সব হাসপাতালে পেয়েছেন ১২ জন ভুয়া ডাক্তার। এমনকি এসব ভুয়া ডাক্তার অপারেশনও করছিলো। মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ও রি-এজেন্ট নামিদামি হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করেছেন।