গার্লস ও কেরুজ হাইস্কুলে অভিযান ॥ অভিযুক্ত ৯ শিক্ষকের বিরুদ্ধে নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা

দর্শনায় বিদ্যালয়গুলোতে দীর্ঘদিন ধরে চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য

দর্শনা অফিস: নিরক্ষর মুক্ত সমাজ, জাতি ও দেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষার মান উন্নয়নে সরকার নানামুখি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে নতুন পাঠ্যপুস্তক তুলে দিয়ে সৃষ্টি করেছে নতুন অধ্যায়। শিক্ষার ক্ষেত্রে দুর্নীতি দূরীকরণে সরকারের যেমন আন্তরিকতার কমতি নেই, তেমনই বিদ্যালয়ের অবকাঠামো থেকে শুরু করে সব ধরনের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নেই আন্তরিকতার ঘাটতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আধুনিক দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর, আধুনিক প্রযুক্তিতে শিক্ষাদানের জন্য ব্যয় করছে প্রচুর অর্থ। ঠিক তখনই অর্থলোভী এক শ্রেণির শিক্ষক হয়ে উঠেছেন বেপরোয়া। তারা শিক্ষা নয়, অর্থের লোভেই মেতে উঠেছেন। শিক্ষাকে ব্যবসায় পরিণত করে হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রচুর অর্থ, কলুষিত করছে শিক্ষাঙ্গনকে। দর্শনার অভিভাবক মহলের দীর্ঘদিনের অভিযোগ কোচিং সেন্টার পরিচালিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ রয়েছে, বিদ্যালয়ে কোচিংয়ে পড়াতে না দেয়া হলে শ্রেণিকক্ষে রীতিমত অপমান করা হয়ে থাকে শিক্ষার্থীকে। তাছাড়া পরীক্ষার খাতায় ভালো লিখলেও নম্বর কম দেয়ার অভিযোগতো রয়েছেই। সম্প্রতি সময়ে দর্শনার বেশ কয়েকজন শিক্ষক কোচিং বাণিজ্য করে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছে পরিণত হয়েছেন। দালান-কোটা, জমিজমা, গাড়ি ক্রয়সহ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নামে-বেনামে জমা রাখা হয়েছে প্রচুর অর্থ। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক দায়িত্বভার গ্রহণের পরপরই শিক্ষার মান উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। কোচিং বাণিজ্যের ব্যাপারে তিনি কয়েকবার হুশিয়ার করেছেন বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা কার্যক্রমের বিষয়ে একাধিকবার পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদ। জেলা প্রশাসকের হুশিয়ারি অনেকটাই তোয়াক্কা না করেই দেদারছে কোচিং বাণিজ্য চলছিলো। দর্শনা কেরুজ হাই স্কুল, দক্ষিণচাঁদপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মেমনগর বিডি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও আলহেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকরা কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে আসছে। মোটা অঙ্কের বেতনে অনিচ্ছা সত্বেও সচ্ছল পরিবারের সন্তানেরা কোচিংয়ে অংশ নিতে পারলেও বিপাকে পড়তে হয়েছে স্বল্প আয়ের মানুষের সন্তানদের। কোচিংয়ে ভর্তি না হওয়ায় দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের কটাক্ষ ও অপমান-অপদস্ত করতে দ্বিধাবোধ করেন না অভিযুক্ত অর্থলোভী শিক্ষকরা। বর্তমান সময়ে অনেকটাই কোচিং বাণিজ্যের কারণে ঝড়ে পড়েছে বহু মেধাবি শিক্ষার্থী। দর্শনার বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন কোচিং সেন্টার বন্ধ ও অভিযুক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিভাবকদের দাবি বারবার উপেক্ষিত হয়েছে। দেরিতে হলেও সময় উপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসন। খানেকটা আকস্মিকভাবেই গতকাল সোমবার বিকেল ৩ টার দিকে কোচিং চলাকালীন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দীন আহমেদের নির্দেশে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) জসিম উদ্দিনের নেতৃত্বে অভিযান চালানো হয় দর্শনা কেরুজ হাইস্কুল ও মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে। দুটি বিদ্যালয়ে কোচিং বাণিজ্য হাতেনাতে ধরে ফেলেন প্রতিনিধিদল। বালিকা বিদ্যালয়ে প্রায় দেড়শ শিক্ষার্থীকে কোচিংরত অবস্থায় পাওয়া গেলেও কেরুজ হাইস্কুলে পাওয়া গেছে প্রায় সাড়ে ৩শ’ শিক্ষার্থী। এ সময় কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে শোনেন নানাবিধ অভিযোগ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগে বলা হয়, ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত কোচিং বাধ্যতামূলক করেছে শিক্ষকরা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ৬শ’ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত কোচিং ফি দিতে হয়। কোচিংয়ে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে ফরম পূরণের ব্যবস্থা ও অভিনব কৌশল। কোচিং ক্লাসসহ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ভিডিও ধারণ করেন কর্মকর্তারা। শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে না আসার জন্য বলে দেন প্রতিনিধিদলের কর্মকর্তারা। কোচিং বাণিজ্যে কেরুজ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নাছিমা খাতুনসহ বেশ কয়েকজন জড়িত থাকলেও তারা সুযোগ বুঝে সটকে পড়ার অভিযোগ উঠেছে। পরপরই কর্মকর্তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে অভিযুক্ত শিক্ষকদের। অভিযুক্ত দর্শনা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক একেএম হুমায়ন কবির, সহকারী শিক্ষিকা নাসরিন আক্তার শিলু, সহকারি শিক্ষক হাফিজুর রহমান হাফিজ, দর্শনা কেরুজ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ইকবাল রেজা, আশরাফ হোসেন, নান্টু, ফারুক হোসেন, আসমা খাতুন অভিযান পরিচালনকারি কর্মকর্তাদের কোনো প্রশ্নের সদুত্তোর দিতে পারেননি। ফলে এ ৯ শিক্ষককের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমাণসহ উপস্থাপন করা হয়েছে জেলা প্রশাসকের নিকট। এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) জসিম উদ্দিন বলেছেন, অভিযান চালিয়ে কোচিং চলাকালীন দুটি বিদ্যালয়ের ৯ শিক্ষক ও প্রায় ৫শ’ শিক্ষার্থীকে পাওয়া গেছে। ৯ শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিতভাবে পাঠানো হয়েছে। অভিযানে আরও উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলা গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র উপ-পরিচালক আবু জাফর ইকবাল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাপিয়া আক্তার, ইফফাত আরা জামান উম্মি ও চৌধুরী মোস্তাফিজুর রহমান। অভিযোগ উঠেছে, হাতেনাতে ধরা পড়া শুধু ৯ জনই নয়, এ বাণিজ্যে জড়িয়ে রয়েছে বহু শিক্ষক। যাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। কোচিংয়ের সাথে জড়িত অভিযুক্ত প্রত্যেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানা গেছে। কোচিং বাণিজ্য করে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরেছে শিক্ষকরা। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ ঘোষণার পরও কতিপয় অর্থলোভী শিক্ষকরা কার ইশারায় মেতেছিলো তা খতিয়ে দেখা উচিৎ বলে দাবি তুলেছেন অভিভাবক মহল। এছাড়া অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে যেনো ফুঁসে উঠেছেন এলাকাবাসী।