সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেবে বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির মধ্যে নানামুখী ভাবনা তৈরি হলেও সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে চায় দলটি। আগামী নির্বাচনের বিষয়টি মাথায় রেখে অত্যন্ত ‘সংযত ও সতর্কতা’ ধীরে চলার কৌশল নিয়েছেন তারা। আপাতত খালেদা জিয়ার জামিনকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়ার পাশাপাশি দলের ঐক্য ধরে রাখা, দলের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং আগামী নির্বাচনের জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেই এগিয়ে যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সিনিয়র নেতাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে দল পরিচালনা করা শুরু করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহের পুরোটা সময় খালেদা জিয়ার জামিনের চেষ্টা করার পাশাপাশি রাজপথের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিও অব্যাহত রাখবে বিএনপি। কোনো অবস্থাতেই হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিতে যাবে না তারা। এছাড়া খালেদা জিয়ার ওপর অবিচার হয়েছে এমন বিষয় আন্তর্জাতিক মহলকে নানাভাবে জানানোর চেষ্টা করবে দলটি।

দলের পক্ষ থেকে গতকাল শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের কাছে খোঁজখবর নেয়া শুরু করেছেন তারেক রহমান। জামিন ও সাংগঠনিক তৎপরতা নিয়ে খালেদা জিয়া কারগারে যাওয়ার পর দলের মহাসচিব, সিনিয়র কয়েকজন নেতা এবং আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। আপাতত সবার আগে খালেদা জিয়ার জামিনের ব্যাপারে করণীয় নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে রোববারের মধ্যে একটি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারেক। আইনজীবীরা কতোদিনের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিন পেতে পারেন এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ধারণা দিয়েছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক কারণে অনেক বিলম্ব হতে পারে এমন কথাও বলেছেন।
খালেদা জিয়ার জামিনের আবেদনের বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, রায়ের সার্টিফাইড অথবা অথেনকেটেড কপি পেলে রোববারই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ফাইল করা হবে এবং জামিন চাওয়া হবে। একই বিষয়ে আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, তারা আদালতে সার্টিফাইড কপির একটি সত্যায়িত ফটোকপি চেয়েছেন। যাতে করে আগামীকাল রোববার অথবা সোমবারের মধ্যে হাইকোর্টে আপিল করা যায়। আদালত সেটি বিবেচনা করবেন বলে তিনি মনে করেন। এছাড়া ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও জামিনের বিষয়ে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন বলেও জানান সানাউল্লাহ মিয়া।

এদিকে রায়ের পরে নীরব প্রতিবাদের ভূমিকা নিয়ে দলটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। সিনিয়র নেতারা খালেদা জিয়ার নির্দেশনা অনুযায়ী কঠোর কর্মসূচি না দেয়ার কথা বললেও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এই সিদ্ধান্তের জন্য ক্ষুব্ধ। এ বিষয়ে দলের এক সিনিয়র নেতা বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়া না দেখানোর সিদ্ধান্তে তৃণমূলে ক্ষোভ আছে। তাদের নানাভাবে শান্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগামী নির্বাচনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা বিএনপি প্রধান টার্গেট। তাই এ সময়ে সেই লক্ষ্যকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এখন প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে শক্তি ক্ষয় করলে মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে। এ জন্য আপাতত কোনো হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে নতুন করে বিপর্যয়ে পড়া যাবে না।

এই নেতা আরও জানান, খালেদা জিয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশনার কারণেই রায় ঘোষণার পর সাংঘর্ষিক কোনো অবস্থানে যায়নি বিএনপি। আগামী নির্বাচন বিএনপির মূল লক্ষ্য। সেই পথে সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিতে তারা রাজি নন। সতর্ক ও সংযত অবস্থানে থেকেই পরিস্থিতি সামাল দেবেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দলের শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় বিএনপি। দলটির হাইকমান্ড মনে করছে, বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের দাবি উপেক্ষা করে ক্ষমতাসীনরা দলীয় সরকার তথা নিজেদের অধীনে নির্বাচন করে আবারও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকতে চাইবে। সে জন্য নির্বাচনকালীন নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মানতে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করতে হবে। আর এই দাবি আদায়ে আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। সে জন্য সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দলের শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। তাই বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব বেগম জিয়ার রায়কে ঘিরে সরকারের কোনো ফাঁদে পা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একই সঙ্গে রায় ঘিরে তৃতীয় কোনো পক্ষ যাতে কোনো স্যাবোটাজ (অন্তর্ঘাতমূলক কাজ) করতে না পারে সে ব্যাপারেও সতর্ক দলটি। দলটির নেতাদের পর্যালোচনা, রায়কে ঘিরে আক্রমণাত্মক কর্মসূচি ঘোষণা করলে সরকারও সর্বোচ্চ হার্ডলাইনে চলে যাবে, সারাদেশে নেতাকর্মীদের আরও ব্যাপক ধরপাকড় করবে। সহজে তাদের জামিনও হবে না। এর ফলে বিএনপি আবারও ব্যাকফুটে চলে যেতে বাধ্য হবে।

২০১৪ ও ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনে নেমেছিল দলটি। আন্দোলন দমনে সরকারও বিএনপির নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় চালায়। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে দুই-তিন বছর লেগে যায় বিএনপির। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে ভবিষ্যৎ আন্দোলন সফলে এক্ষুনি কঠোর কর্মসূচিতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।  দলটির আশা, আইনি প্রক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া জামিন পেয়ে যাবেন। জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন দীর্ঘায়িত হলে এবং সারাদেশে নেতাকর্মীদের ধরপাকড়ের মাত্রা যদি আরও তীব্র হয় তাহলে সেক্ষেত্রে দলটির কর্মকৌশলেও পরিবর্তন আসতে পারে। পাল্টে যেতে পারে কর্মসূচির ধরন।
এদিকে খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ের বাইরে দলের এখন সবেচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে দলীয় ঐক্য ধরে রাখা নিয়ে। এজন্য কারগারে যাওয়ার পরের দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হয়েছে। এই ইসু্যতে সিনিয়র নেতাদের এলোমেলো কোনো কথা না বলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া দলীয় সিদ্ধান্ত মুখপাত্র ছাড়া অন্য কাউকে ঘোষণা না দেয়ারও কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কারাগারে যাওয়ার আগেই খালেদা জিয়া বলে গেছেন, এবার যারা বিশ্বাসঘাতকতা করবে তাদের আর কোনো অবস্থাতে ক্ষমা করা হবে না।

এদিকে খালেদা জিয়া সুবিচার পাননি এমন দালিলিক প্রমাণ আন্তর্জাতিক মহলে পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছে বিএনপি। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খালেদা জিয়ার সাজার প্রতিবেদন প্রকাশের পর রায়-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়েছে জাতিসংঘ। উদ্ভূত পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে সব পক্ষকে শান্ত থাকার আহ্বানও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থা।

অন্যদিকে গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে শুক্রবার বিকেলে খালেদা জিয়ার মামলা এবং তাকে জেলে প্রেরণসহ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশে কর্মরত বিবিসি, ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি, মার্কিন বার্তা সংস্থা এপি, জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেল, ভারতীয় গণমাধ্যম জি মিডিয়াসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে ব্রিফিং করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

ব্রিফিংয়ে অভিযোগ করা হয়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতেই দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আরও বলেন, যে ধারায় বেগম খালেদা জিয়াকে দণ্ড দেয়া হয়েছে সেটা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ধারা নয়। তাই দুর্নীতির দায়ে খালেদা জিয়াকে অভিযুক্ত করা যায়নি বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। সরকার বাধা না দিলে তিনি প্রচলিত আইনেই বেরিয়ে আসবেন।

রায়কে ঘিরে সারাদেশে বিএনপির সাড়ে ৩ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে দাবি করে মির্জা ফখরুল বিএনপি চেয়ারপারসনসহ সব নেতাকর্মীর মুক্তি দাবি করেন। এ সময় ব্যারিস্টার মওদুদ ও খন্দকার মোশাররফ বলেন, দুর্নীতির সঙ্গে খালেদা জিয়ার কোনো সংযোগ নেই। এই মামলার বাকি পাঁচ আসামির ক্ষেত্রে দুর্নীতির সংযোগের কথা বলা হলেও রায়ে খালেদা জিয়ার দুর্নীতির সংযোগের কথা বলা নেই। বিএনপি নেতারা বলেন, সরকারি তহবিলে এতিমদের জন্য কোনো তহবিল নেই। কুয়েত থেকে আসা টাকা লেনদেন করেছেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। টাকা ছাড় করার জন্য তিনি সরকারকে ব্যবহার করেছেন। সেই টাকার কিছুটা খরচ হলেও বাকিটা ব্যাংকে আছে যা এখন সুদে-আসলে তিন গুণ হয়েছে। ফলে তহবিল তছরুপের কোনো বিষয় এই মামলায় নেই।
তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার বিষয়ে বিএনপি নেতারা বলেন, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই এই দায়িত্ব পেয়েছেন। তার ও দলের স্থায়ী কমিটির নেতৃত্বেই দল চলবে।