রয়টার্সের রিপোর্টে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞের বিবরণ

মাথাভাঙ্গা মনিটর: মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশ রোহিঙ্গাবিরোধী বৌদ্ধ বাহিনী গড়ে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যাযজ্ঞ চালায়। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের পাশাপাশি তাদের সহায়-সম্পদ লুট ও গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় তারা। দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশ গ্রামে গ্রামে রোহিঙ্গাবিরোধী বৌদ্ধ বাহিনী গড়ে তোলে। গ্রামবাসীকে উসকে দেয়ার পাশাপাশি নিধনযজ্ঞে সরাসরি অংশ নেয় তারা। এ ক্ষেত্রে ইউনিফর্ম খুলে বৌদ্ধ অধিবাসীদের সঙ্গে যোগ দেয় সেনাবাহিনী। রয়টার্সের বিশেষ অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন করে সহিংসতা শুরুর কয়েক দিন পর ২ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ গ্রামবাসীকে নিয়ে রাখাইনের একটি প্রত্যন্ত গ্রামের ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে সেনাবাহিনী। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং কীভাবে তা ঘটে তা সরেজমিন অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন করে রয়টার্স। প্রতিবেদনকালে রয়টার্সের দুই সাংবাদিককে গ্রেফতার করে মিয়ানমার পুলিশ।

জাতিসংঘসহ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো মিয়ানমার সেনাবাহিনী এসব কর্মকাণ্ডকে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ বললেও এমন অভিযোগ করলেও তা অস্বীকার করে আসছিলো মিয়ানমার সরকার। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে দেশটির সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়াং। ফেসবুকে দেয়া এক পোস্টে ইন দিন গ্রামের ১০ জন রোহিঙ্গাকে হত্যার কথা স্বীকার করেন তিনি। তবে বরাবরের মতো তিনি তাদের ‘বাঙালি জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। দাবি করেন, গ্রামবাসী তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করার পর হত্যা করা হয়।

তবে রয়টার্সের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, এদের দু’জনকে গ্রামবাসী হত্যা করলেও বাকি আটজনকে সেনাবাহিনীই হত্যা করেছে। হত্যার আগে তাদের সামনেই গণকবর খোঁড়ে গ্রামবাসী। এরপর গুলি করে হত্যা করে তাদেরকে গণকবরে ফেলে দেয়া হয়। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ গ্রামবাসীর কাছে পাওয়া ছবি, আর ওই কবর খননের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাবেক এক বৌদ্ধ সেনাসদস্যের কাছে ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে রয়টার্স। শুক্রবার এক বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের এ ঘটনাটি তুলে এনেছে রয়টার্স। সঙ্গে প্রকাশ করেছে হত্যাকাণ্ডের তিনটি ছবি।

বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী পাহাড়ের পাশেই ইন দিন গ্রাম। সেখানে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পর্কজনিত উত্তেজনা থাকলেও অনেক দিন ধরেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল তাদের। ২০১৬ সালের অক্টোবরে সেখানকার তিনটি পুলিশ চেকপোস্টে হামলা চালায় রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা। ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট আবারও হামলার পর ভয়াবহ অবনতি হয় পরিস্থিতির। উপাসনালয়ে আশ্রয় নেয় কয়েকশ’ বৌদ্ধ। তাদের একজন জানান, রোহিঙ্গাদের হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার ভয় পেয়েছিলেন তারা। এরপর ২৭ আগস্ট সেনাসদস্যরা গ্রামে আসে বৌদ্ধদের সুরক্ষা দেয়ার অজুহাতে। তবে গ্রামে এসে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষকে তারা উসকানি দেয় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে অংশ নিতে। এরপর গ্রামবাসী যোগ দেয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে। ওই বাহিনীর নয়জন সদস্য ও গ্রামের আরও দু’জন বাসিন্দা জানান, ২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের সহিংসতার পরই এমন একটি বাহিনী গড়ে তোলা হয়।

বৌদ্ধদের ওই বাহিনীতে যোগ দেন দমকল কর্মী, স্কুলশিক্ষক, শিক্ষার্থী, বেকার যুবকসহ অনেকেই। দলটির ৮০-১০০ জন সদস্যের প্রত্যেকের কাছেই ধারালো অস্ত্র ও লাঠি থাকত। কারও কারও কাছে থাকত আগ্নেয়াস্ত্রও। যেদিন রোহিঙ্গাদের ওপর ৩৩তম বাহিনী অভিযান শুরু করে, সেদিনই অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দেয় তারা। আধা সামরিক বাহিনীর দুই পুলিশ সদস্য বলেন, তারা ওপর থেকে নির্দেশ পেয়েছিলেন যেন সব রোহিঙ্গাকে ‘সাফ’ করে দেয়া হয়। অভিযানে অন্তত ২০ জন সেনাসংশ্লিষ্ট ছিলেন। পাঁচ থেকে সাতজন পুলিশ সদস্যও ছিল সঙ্গে। ক্যাপ্টেন বা মেজর পদমর্যাদার একজন ছিলেন নেতৃত্বে। উদ্দেশ্য ছিল একটাই- রোহিঙ্গারা যেন ফিরে আসতে না পারে। ওই পুলিশ সদস্য জানান, ‘রোহিঙ্গারা যদি থাকে, খেতে পারে, তবে আবারও হামলা চালাতে পারে। এ জন্য আমরা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিই।’