৪০ কোটি টাকার সাপের বিষ আটকের পর হঠাৎ তদন্ত বন্ধ

নেপথ্যে মোটাঅঙ্কের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করে প্রতি বছর শত শত কোটি টাকার সাপের বিষ পাচার হয়ে যাচ্ছে চীন, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এক আউন্স সাপের বিষের দাম ১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ থেকে সাপের বিষ কেনার জন্য বিদেশিদের কয়েকটি চক্র সক্রিয় রয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিভিন্ন স্থান থেকে মহামূল্যবান সাপের বিষ আসে বাংলাদেশে। এরপর ক্রেতাদের সঙ্গে দর কষাকষির পর তা বিক্রি হয়ে যায়। সিন্ডিকেটটি বাংলাদেশ থেকে এই বিষগুলো কিনে ভারতে নিয়ে যায়। এরপর সেখান থেকেই নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে যায়। বাংলাদেশে গত ৮ বছরে কয়েকশ কোটি টাকার সাপের বিষ উদ্ধার করেছে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। কিন্তু কোনটিরই তদন্তের অগ্রগতি হয়নি।
জানা গেছে, গত ১ অক্টোবর ৪০ কোটি টাকার সাপের বিষসহ ছয় চোরাচালানিকে উত্তরা দক্ষিণ খান ও বাড্ডা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেফতারকৃতরা হলেন পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া থানার তুষখালী গ্রামের মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে মো. খলিলুর রহমান (৪৯), পাবনা জেলার ফরিদপুর থানার রাউত নাস্কা পাড়া গ্রামের মৃত গোলজার হোসেনের ছেলে কেএম মনসুর (৬০), চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা থানার নাফিতখালী গ্রামের হান্নান হোসেনের ছেলে উজ্জ্বল হোসেন, জামালপুর জেলার মোসলেখাবাদ থানার বাসিন্দা আব্দুল আউয়ালের ছেলে মাসুদ (৪০)। এই চারজনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রনি ও তুহিন নামক আরো দুজনকে গ্রেফতার করা হয়। এই চালানটি খলিলুর রহমানকে বিক্রি করার জন্য মনসুর দেয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই খলিল তুষখালী ও তেলিখালী এলাকায় ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ বিষয়টিও পুলিশ অনুসন্ধান করে দেখছে। জানা গেছে, তাদের গ্রেফতারের পর ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হলেও এখনো পর্যন্ত তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই। বলতে গেলে এক ধরনের তদন্ত বন্ধই আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। লেনদেনের বিষয়টি ফয়সালা হওয়ায় এখন হঠাত তদন্ত বন্ধ বলে অভিযোগ এসেছে। এজাহারে পুলিশ বাদি হলেও তদন্তে কেন পুরো ঘটনার তথ্য বের হয়ে আসছে না, রহস্য কী এমন নানা প্রশ্ন এখন সবার কাছে। গ্রেফতার হওয়া চার জন সাপের বিষ পাচারে আন্তর্জাতিক চোরাচালনের সঙ্গে জড়িত। গ্রেফতারকৃত মো. খলিলুর রহমান উত্তর বাড্ডা থানা এলাকায় বসবাস করেন। উত্তরা পূর্ব থানাধীন জামতলা এলাকায় গোপন সংবাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টিম ইনচার্জ জানতে পারেন যে, দক্ষিণ খান থানাধীন মোল্লার টেক বাড়ি নং ৫, ওয়ার্ড নং ৪, লেন ২ নম্বর বাসায় কোমরা সাপের বিষ বিক্রি করার একটি চক্র সাপের বিষ নিয়ে অবস্থান করছে। সন্ধ্যা ৭টায় ওই বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে মনসুরের শয়নকক্ষে খাটের নিচ থেকে উদ্ধার করে সাপের বিষ। তার বিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বাড্ডা থানাধীন পুরান থানা রোডে ১০৩ নম্বর বাড়িতে খাটের নিচ থেকে মেহেরুন ফ্যাশনের শাদা রঙের ব্যাগের মধ্যে রক্ষিত দুটি সাপের বিষের কাঁচের জার জব্দ করা হয়। জব্দকৃত আলামতের প্রতিটি জারের গায়ে ইংরেজিতে ‘কোবরা স্নেক পয়জন অব ফ্রান্স রিড ড্রাগন কোম্পানি মাডেইন ফ্রান্স, কোড নম্বর ৮০৯৭৫ কম্পিউটার টেস্ট ১০০ ভাগ গ্রানট্রি ড্রাবল স্নেক পয়জন ট্রু পাউন্ড নট ইউস পুশিং ডেনজারেস সিগনাল ১৪৭৭৬৭৬ ডলার’ লেখা ছিল। জব্দকৃত আলামতের ওজন আনুমানিক ১০ পাউন্ড। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন যে, এসব সাপের বিষয় তারা চোরাই পথে চোরাচালানের মাধ্যমে আমদানি করে থাকে। তারা এসব সাপের বিষ বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির লোকজনদের দেখিয়ে তাদের নিকট সরবরাহ করার কথা বলে প্রতারণার মাধ্যমে মোটাঅঙ্কের টাকা হাতিয়ে আত্মগোপন করে। এসব আসামি প্রতারণার উদ্দেশে বিদেশ থেকে চোরাই পথে কোবরা সাপের বিষ আমদানি করে নিজ হেফাজতে রেখে পেনাল কোটের ৪২০/৪০৬/৩৪ ধারা তত্সহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫এর খ ধারায় অপরাধ করেছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এখানেই শেষ। তদন্তে আর কোনো অগ্রগতি নেই। পরবর্তীতে এসব আসামিদের কাছ থেকে মোটাঅঙ্কের টাকা উেকাচ গ্রহণ করার পর পুরো মামলা হয়ে যায় দুর্বল এবং আসল বিষ হয়ে যায় নকল। পরে তারা আইনের ফাঁকফোকড় দিয়ে বের হয় যায়।
মামলার বাদি এসআই মো. নাসির উদ্দিন জানান, তারা গ্রেফতার হয়েছে, মালামাল জব্দ হয়েছে। এ মামলার পরবর্তী তদন্ত সম্পর্কে আমার আর জানা নেই।
ঢাকা মহানগর যুগ্মকমিশনার শেখ নাজমুল আলম জানান, এ মামলার তদন্ত চলছে। সাপের বিষ চোরাচালানের পুরো নেটওয়ার্কের রহস্য উন্মোচনের কার্যক্রম চলছে। গ্রেফতারকৃতরা প্রচারক চক্র। তারা সাপের বিষ বিক্রির নামে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে প্রতারণা করে আসছে।
এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (ডিবি, উত্তর বিভাগ) ইন্সপেক্টর আরমান আলী বলেন, আসামীদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা বলছেন, এটা তাদের প্রথম চালান। তবে জব্দকৃত এগুলো সাপের বিষ কিনা পরীক্ষার জন্য পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। এ রিপোর্ট প্রাপ্তির পর মামলার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি বলেন, এগুলোর একটি চক্র আছে। তারা আসল বিষ আনে। এগুলো রেখে নকল বানিয়ে প্রতারণা করে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে সোমালিয়ার বিভিন্ন চক্র সংগ্রহ করে এই বিষ। সেখান থেকে ভারত হয়ে তা চলে যায় চীনে। অতীতে সাপের বিষ উদ্ধারের সময় আটককৃত ব্যক্তিদের নিকট থেকে এ তথ্য পায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সূত্র জানায়, ভারত ও বাংলাদেশ ঘুরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে চলে যায় এই বহু মূল্যবান সাপের বিষ। নানাবিধ কৌশলে তা চীনে নিয়ে যায় জলদস্যুরা। ঠিক কয়টি হাত ঘুরে পাচার হয়, তা এখনও পরিষ্কার নয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তদন্তে দেখা গেছে, সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারে যুক্তদের একাধিক সিন্ডিকেট থাকে। এক দেশে সামগ্রী কেনা এবং তারপরে তা অন্য দেশে বিক্রি করার কাজ করে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা। আর একেকটি সিন্ডিকেটে ৩০-৪০ জন করে থাকে।
যেভাবে বিক্রি হয়- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, প্রথমে চক্রটি বিষের বোতলের ছবি নিয়ে বিক্রির জন্য ক্রেতা খোঁজে। ক্রেতা পেলে ক্রেতার প্রতিনিধি এবং বিক্রেতার প্রতিনিধির মধ্যে বিষের ছবি দেখাদেখি হয়। এরপর তার ভিডিও দেখানো হয় বিক্রেতাকে। ভিডিও দেখানোর পর ক্রেতা নিশ্চিত হন বিক্রেতার নিকট সাপের বিষ রয়েছে। এরপর বিক্রেতার কাছে চাওয়া হয় ক্যাটালগ। দাম নির্ভর করে ক্যাটালগের ওপর। ক্যাটালগ না থাকলে বিষ বিক্রি হয় না। বিক্রেতারা কোনো সময় প্রথমে ক্রেতাদের মূল ক্যাটালগ দেয় না। ক্যাটালগের রঙিন ফটোকপি দেয়া হয়। এটা দেখে পছন্দ হলে দাম নির্ধারণ হয়। এর পরের ধাপে হয় স্যাম্পল পরীক্ষা। প্রতি সেট বোতলের সঙ্গে থাকে স্যাম্পল। বায়াররা ল্যাবরেটরিতে স্যাম্পল পরীক্ষা করেন। স্যাম্পলের কোড নম্বর এবং মূল বোতলের কোড নম্বর এক থাকে। ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর সাপের বিষ প্রমাণিত হলেই কেনা-বেচা হয়। আর সেই সময় মূল বোতলের সেট বুঝে নেয়ার সময় এই কোড নম্বর মিলিয়ে নেয়া হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত- বিশেষ করে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো রোগের ওষুধ তৈরিতে সাপের বিষ খুবই কার্যকর। কারণ হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ থ্রম্বোসিস বা রক্তের জমাট বাঁধা। যেসব ওষুধ দিয়ে রক্তের জমাট বাঁধা দূর করা বা প্রতিহত করা যায়, সেগুলোতে রয়েছে আবার অনেক ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কিন্তু সাপের বিষ রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে সাহায্য করে। তাই সাপের বিষের মাধ্যমেই চিকিত্সার চেষ্টা চলছে। এছাড়া সাপের কামড় খাওয়া রোগীর চিকিত্সায় যে অ্যান্টি-ভেনিন ইঞ্জেকশনটি দরকার, সেটিও বানাতে দরকার সাপের বিষ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের একাধিক শিক্ষক জানান, কোবরা সাপের বিষ থেকে সাপ কামড়ানোর চিকিত্সার জন্য প্রতিষেধক তৈরি হয়। এছাড়া ক্যান্সার চিকিত্সার জন্য ওষুধ তৈরিতে কোবরা সাপের বিষ একটি মূল্যবান উপাদান। বাংলাদেশে কোনো ওষুধশিল্পে সাপের বিষ ব্যবহার না হলেও উন্নত বিশ্বের গবেষণাগারে পটাশিয়াম সায়ানাইডের টক্সিন তৈরিতে সাপের বিষ ব্যবহার হয়। এ কারণে ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, অস্ট্রিয়া যেসব দেশ রাসায়নিক মৌল বা যৌগ উপাদান তৈরি করে তাদের কাছে কোবরার বিষ খুবই মূল্যবান।