বিদ্যমান সংবিধানে সমঝোতার সুযোগ কোথায়

স্টাফ রিপোর্টার: বিদ্যমান সংবিধানেই একাদশ সংসদ নির্বাচন গত বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নোত্তরে এমন বার্তাই দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনা। আগামী সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সামগ্রিক বক্তব্যের মূলকথা হলো সংবিধানের বাইরে কিছু হবে না। যেহেতু সরকার সংবিধানের বাইরে যেতে রাজি নয়, সেজন্য বিএনপি বা দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে কোনো আলোচনার দরকার আছে বলেও মনে করেন না তিনি।‘বিএনপির সাথে আলোচনার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না, বিএনপি নাকে খত দিয়ে নির্বাচনে আসবে’সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সম্পর্কে কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা ও নাগরিক সমাজের কেউ কেউ ব্যক্তিগত মত দিয়ে বলেছেন, ‘গণতন্ত্রে সমঝোতা অপরিহার্য’। আবার কারও কারও মতে, বিদ্যমান সংবিধানে সমঝোতার সুযোগ কোথায় বা কীভাবে? কারণ বর্তমান সংবিধানে অনির্বাচিত নির্দলীয় সরকারের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি বিএনপির দাবি অনুযায়ী ভোটের আগে সংসদ ভেঙে দেয়ারও কোনো সুযোগ নেই সংবিধানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হাফিজ উদ্দিন আহমেদ  বলেছেন, ‘আমরা এখনও মনে করি পুরোপুরি দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের সময় বর্তমান সংসদ বহাল থাকবে, এটা একটা সমস্যা। নির্বাচনের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংজ্ঞা ও প্রশাসনে রাজনীতিকরণের বিষয়টিও একটা সংকট। আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে আমরা বলে এসেছি- নির্বাচন মানে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। নির্বাচন মানে কারচুপি বা একরতফা নির্বাচন নয়।’

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদ্যমান ব্যবস্থায় সংবিধান সংশোধন ছাড়া নির্বাচনকালীন সরকারের অন্য কোনো ব্যবস্থায় ফেরা সম্ভব নয়। আবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ না চাইলে বর্তমান সংসদে নির্বাচিত সরকারের বিকল্প কোনো ব্যবস্থা প্রণয়নও সম্ভব নয়। কারণ সহায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থায় ফিরতে হলে আবার সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য। সংবিধান সংশোধনের জন্য যে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দরকার তা চলতি সংসদে আওয়ামী লীগের এককভাবেই রয়েছে। এমনকি সরকারের মেয়াদও প্রায় এক বছর বাকি রয়েছে। বিরোধী দলগুলো যদি সরকারকে বাধ্য করতে পারে তাহলেই কেবল সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় আপসে পৌঁছুনো সম্ভব।

তবে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করেই বলা হচ্ছে আগামী নির্বাচনও বিদ্যমান সংবিধান মেনেই হবে, এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। সরকার এই অবস্থানে অনড় থাকলে তাদের অধীনেই নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে বিএনপিসহ সব দলকে।

বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, বর্তমান সংবিধানে নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের বাইরে কোনো ব্যবস্থা নেই। নির্বাচিত এমপি ছাড়া কোনো সরকারব্যবস্থা এতে রাখাও হয়নি। নির্বাচিত সংসদ মানে দলীয় সরকার। বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলছে। এখানে ‘তত্ত্বাবধায়ক’ বা ‘অন্তর্বর্তী’ নাম মুখ্য নয়। মুখ্য হল দলীয়, নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে-সেটি। দলীয় সরকার না হলে সেক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে বিভক্তি ভোটে পাস হওয়া পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে বর্তমান সংবিধান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এই সংবিধান অনুযায়ী নির্দলীয় সরকারব্যবস্থার অধীনে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো সুযোগ নেই। পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সম্পর্কিত সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৮(খ), ৫৮(গ), ৫৮(ঘ) ও ৫৮(ঙ) বিলুপ্তির কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিলুপ্তি ঘটেছে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ যার সরল অর্থ দাঁড়ায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদের শেষ ৯০ দিনে একাদশ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেক্ষেত্রে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, তার মন্ত্রিসভা ও বর্তমান সংসদ সদস্য সবাই ওই ৯০ দিনেও স্বপদে বহাল থাকবেন। স্ব-স্ব পদে বহাল থেকেই তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রশ্নেই শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান বিপরীত মেরুতে নয়। নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল রাখা না রাখার প্রশ্নেও প্রধান দুই দল বিপরীতমুখী। আওয়ামী লীগের সাফ কথা, প্রচলতি সংবিধান অনুযায়ী-অর্থাৎ বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই আগামী নির্বাচন হবে। আর বিএনপির দাবি, সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপেও বিএনপি সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। উদ্ভুত প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সামগ্রিক যে অবস্থা, তাতে তো আলোচনার কোনো পরিবেশ দেখছি না। দু্ই পক্ষই বিপরীত অবস্থানে অনড়। এ অবস্থায় আলোচনা হলেও সেটি অর্থবহ হবে-এমনটা আশা করাও দুরূহ। তার মতে, অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বিএনপির পক্ষে আবার নির্বাচন বর্জন করা কঠিন, এটা সরকারও জানে বিএনপিও জানে। যেহেতু সরকার সংবিধানে থেকেই নির্বাচনের আয়োজন করবে বলে মনে হচ্ছে, সে অবস্থায় অন্য কোনো উপায় নেই, ব্যতিক্রমী বা অলৌকিক কিছু আশা করাও অমূলক। এসব কিছুর মধ্যেও নাগরিক সমাজ সবসময়ই সমঝোতা ও আলোচনার কথা বলবে, এটা দোষের কিছু নয়। এখন আমরা প্রত্যাশা করবো- নির্বাচনটা যেন অংশশগ্রহণমূলক হয় এবং সেটি যেন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়।

উদ্ভুত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে অনেকে সংলাপের তাগিদ দিচ্ছেন। কিন্তু এই সংলাপের প্রয়োজনীয়তা কেন এবং এর এজেন্ডা কী হবে- তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে। এই প্রশ্ন উত্থাপনকারীদের মতে, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটেছে। কখন, কার অধীনে কীভাবে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে-অর্থাত্ নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বাতলানো আছে সংবিধানে। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এক মুহূর্তের জন্যও অনির্বাচিত সরকার গঠনের সুযোগ নেই। বিএনপির দাবির সঙ্গে বিদ্যমান সংবিধানের অবস্থান বিপরীতমুখী। তারা এ-ও বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সমঝোতা বা মিটমাটের চেয়েও এখানে প্রধান বিষয়টি হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ। সরকার সংবিধানের বাইরে হাঁটবে না, এখন বিরোধী শক্তিগুলো যদি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে এ পথ থেকে ফেরাতে পারে তাহলে সেটি ভিন্ন কথা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, সংবিধান সুরক্ষার শপথ নিয়েই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কাজেই তার দায়িত্ব সংবিধান রক্ষা করা। সে কারণে আমরা মনে করি সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হওয়া উচিত।

সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারও মনে করেন, উভয় পক্ষ গোঁ ধরলে সমস্যার সমাধান হবে না। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাতে হবে। সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে, যাতে আমরা জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারি। বর্তমান সংবিধানে কি সেই সমঝোতার সুযোগ আছে?- এ প্রশ্নের জবাবে ‘সুজন’ সম্পাদক বলেন, সুযোগ আছে, সরকার ইচ্ছে করলেই সেই সুযোগ কাজে লাগানো সম্ভব। সরকার চাইলে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠন করতে পারে। পদ খালি করে সেখানে অন্যদের নির্বাচিত করে এনে সমন্বয় করতে পারে সরকার। এজন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

টিআইবি’র ড. ইফতেখারুজ্জামানের মতে, সংবিধান তো পাথরে খোদাই করা কোনো জিনিস নয়। সেটি পরিবর্তন-সংশোধনশীল। কেউ যদি বলেন যে, সংবিধানে হাত দেয়া যাবে না। তাহলে তাদেরকে এই প্রশ্নও করা যেতে পারে, ’৭২ এর সংবিধান কি এখন আছে? তত্ত্বাবধায়ক তো সংবিধানে ছিল না, সেটি কীভাবে যুক্ত করা হয়েছিলো? আমরা কি এটাও নিশ্চিত করে বলতে পারবো যে, পঞ্চদশ বা ষোড়শ-ই সংবিধানের শেষ সংশোধনী? আর কোনদিন সংবিধান সংশোধন হবে না? তিনি বলেন, দেশবাসী আলোচনার মাধ্যমে শান্তি চায়। সেই আলোচনা কিসের ভিত্তিতে হবে তাও ঠিক করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই। মূল কথা- সমাধানের চাবিকাঠি দুই নেত্রীর হাতে।

এক কলামে