আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার তিয়রবিলার ৯ বছরের শিশু রিয়াজ নিহতের মামলায় সংশ্লিষ্ট আদালতে ১৬৪ ধারায় নিজেকে জড়িত করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে মা জোছনা খাতুন। গতকাল ২০ নভেম্বর আদালতে হাজির করা হলে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জোছনা খাতুন ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত ২২ জুলাই শাসন করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত মায়ের হাতেই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে শিশু রিয়াজের।
জানা গেছে, তিয়রবিলা গ্রামের কুঠিপাড়ার বাসিন্দা শাবান আলীর ৯ বছরের শিশুপুত্র রিয়াজ গত ২২ জুলাই সকালে নিজেদের ঘরের ভেতর মৃত অবস্থায় পড়েছিলো। সেসময় পরিবার ও প্রতিবেশীরা দাবি করে সকালে বিদ্যুতের তার নিয়ে শিশুটি খেলছিলো। অসাবধানতাবশত সে বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়। এক পর্যায়ে কাঁপতে কাঁপতে সে মারা যায়।
তবে মৃত শিশুটির গলায় একটা কালসিঁটে দাগ ছিলো। বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলে যেভাবে শরীরে পোড়ার দাগ থাকার কথা, তা ছিলো না। বিষয়টি রহস্যজনক মনে হওয়ায় আলমডাঙ্গা থানার এসআই একরামুল হক লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চুয়াডাঙ্গা মর্গে প্রেরণ করেন। ওইদিনই এ ঘটনায় থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়।
এদিকে, মৃত্যুর ৩ মাস পর মৃত্যু রহস্য উন্মোচিত হলো। গত ২২ অক্টোবর ওই শিশুর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়। ডা. ওয়ালিউর রহমান নয়ন, ডা. আবু হাসান মোহাম্মদ ওয়াহেদ ও ডা. কানিজ নাঈমার সমন্বিত বোর্ড এ রিপোর্ট দেয়। রিপোর্টে শিশুটিকে গলাটিপে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি ওই ময়নাতদন্ত রিপোর্টটি আলমডাঙ্গা থানায় পাঠানো হয়। মামলার তদন্ত অফিসার আলমডাঙ্গা থানার এসআই একরামুল রিপোর্ট অবগত হয়ে গত ১৯ নভেম্বর সকালে নিহত শিশুর পিতা-মাতাকে থানায় নিয়ে আসেন। মা জোছনা খাতুনকে (২৭) ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক পর্যায়ে অকপটে ঘটনার আদ্যপান্ত খুলে বলে পুলিশের নিকট। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। জোছনা খাতুন জানান, তাদের ২ শিশু পুত্র ছিলো। রিয়াজ বড়, বয়স ৯ বছর। আর ছোট হিরাজ, তার বয়স মাত্র ৬ বছর। ঘটনার দিন অর্থাৎ গত ২২ জুলাই সকাল ৮টার দিকে দুইভাই বিয়ারিং’র চাকার গাড়ি নিয়ে গ-গোল করছিলো। বড় ছেলে রিয়াজ ছোট ছেলে হিরাজকে মারধর করেছিলো। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে জোছনা খাতুন বড় ছেলে রিয়াজকে হাত ধরে ঘরের ভেতর নিয়ে যায়। রেগে গিয়ে প্রথমে গালে চড় মারে। তারপর গলাটিপে ধরে। এ ঘটনার পরপরই রিয়াজের গলা দিয়ে ঘড় ঘড় শব্দ বের হতে থাকে। ভয় পেয়ে জোছনা খাতুন দ্রুত ছেলের গলা ছেড়ে দেয়। সে সময় রিয়াজ ঘরের মেঝেতে পড়ে যায়। পড়ার সাথে সাথে তার মৃত্যু ঘটে। জোছনা খাতুন আরও জানান, ওই ঘরের মধ্যে বিদ্যুতের অনেক তার পড়েছিলো। ছেলের মৃত্যুর পর চিৎকার করে কান্নাকাটি করলে প্রতিবেশীরা ছুটে আসে। তারা ছেলের লাশ পড়ে থাকতে দেখে কিভাবে মারা গেল তা জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু জোছনা খাতুন কাউকে আসল ঘটনা বলেননি। প্রতিবেশীরা ধারণা করে নিয়েছিলো যে, সম্ভবত বিদ্যুতস্পৃষ্টে মারা গেছে শিশু রিয়াজ। সে সময় সকলেই শিশুটির মৃত্যুর কারণ বিদ্যুতস্পৃষ্ট হয়েছে বলে প্রচার করেছিলো।
নিজের হাতে সন্তানকে হত্যার কথা জোছনা খাতুন এতোদিন কাউকে মুখ ফুটে বলতে পারেননি। এমনকি নিজের স্বামীকেও না। শুধু নিজে নিজে অসহায়ের মতো কেঁদেছেন। এই কয়েক মাস ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করতে পারেননি। শুধু ছোট ছেলের জন্যই বেঁচে ছিলেন বলে উল্লেখ করেন। কোনোভাবেই সন্তান মরে যাক, তা জোছনা খাতুন চাননি। প্রথম সন্তান কতো আদরের ছিলো উল্লেখ করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সবকিছু জানার পর গত পরশু বিকেলে নিহত শিশু রিয়াজের বাপ শাবান আলী বাদী হয়ে স্ত্রী জোছনা খাতুনের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। গতকাল সোমবার সংশ্লিষ্ট মামলায় জোছনা খাতুনকে আদালতে উপস্থিত করে থানা পুলিশ। আদালতে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় তিনি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ছবিঃ জোছনা ।