ধান ক্ষেতে পার্চিংয়ের ব্যবহার লাভজনক হয়ে উঠেছে

মনজুর আলম: কীটনাশক ছাড়া ফসল উৎপাদন যেনো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কিন্তু ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় কৃষকদের সচেতনা বৃৃদ্ধি পাওয়াই চাষ পদ্ধতি ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে ব্যপক পরিবর্তন এসেছে। একই সাথে সবজি ও ধান আবাদসহ বিভিন্ন ফসলে বন্যা ও ক্ষরা সহনশীল উচ্চ জাতের বীজের ব্যবহার বেড়েছে। ক্ষেতের ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য অনেক কৃষক ফেরোমন ট্র্যাপ ও বিষটোপ ব্যবহার করছেন। এছাড়া ধান আবাদ লাইন লগো পদ্ধতি, কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে পার্চিংয়ের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক জাকির হোসেন ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরেজমিন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কয়েকটি মাঠে আমন ধানের ক্ষেত পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
তথ্য সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান সরকারের সময় অর্থাৎ ১৯৬৩ সালের দিকে এদেশে ‘ইন্ডিন’ নামের এক প্রকার বিষ ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য ব্যবহার শুরু হয়। ক্রমেক্রমে সবজিসহ ধান ফসলের পোকা দমনের জন্য পণ্যটির ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন কোম্পানি কীটনাশক ব্যবসায়ী ভিত্তিতে বাজারজাত এবং তাদের প্রতিনিধিগণ ফসলে কীটনাশক ব্যবহারের জন্য উদ্ধুদ্ধ করতে থাকেন। বর্তমান দেশে নামে বেনামে তিন শতাধিক কীটনাশক বাজারজাত করণের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে সকল প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কয়েকটি কোম্পানি কীটনাশক বাজারজাত করণের পাশাপাশি অতি গোপনে অল্প সময়ে ফল পাকানো ও মানবদেহের জন্য চরম ক্ষতিকর ফরমালিন বাজারজাত করছেন। তবে কৃষি বিভাগ গত কয়েক বছরে প্রায় দেড় শতাধিক কোম্পানির ওপর কীটনাশক বাজারজাত করণে নিষেধাজ্ঞা করেছেন। একই সাথে কৃষকদের কীটনাশক ব্যহারের সচেতন এবং কৃষিতে সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব কলাকৈশল ব্যবহারে জোরারোপ করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষি বিভাগ কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃৃদ্ধি করে চাষ পদ্ধতি ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এখন অধিকাংশ কৃষকই ধানের পোকা দমনের জন্য বিভিন্ন গাছের ডাল এমনকি কৃষি বিভাগের পরামর্শে ধৈঞ্চা গাছ রোপণ করে পোকা দমন করছেন। এতে একদিকে কোনো প্রকার খরচ ছাড়াই কীটনাশক ব্যবহার না করে ধানের জমির ক্ষতিকর পোকা দমন হচ্ছে।
এ বিষয়ে কৃষিবিদ প্রফেসর আমিনুর রহমান জানান, কৃষক জমিতে পার্চিং ব্যবহার করলে দু ভাবে লাভবান হবেন। একটি অর্থ সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধবভাবে পোকামাকড় দমন অপরটি হচ্ছে পার্চিং তৈরি করতে সাধারণত অফ্রিকান ধৈঞ্চা গাছ ব্যবহার করা হয়। এই গাছের দেহে এবং শিকড়ে বড় নভিউল থাকে। যেখানে রাইজোরিয়াম নামক এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া থাকে যা প্রকৃতির আলো, বাতাস থেকে নাইট্রোজেন তৈরি করে, যা ফসল সহজে গ্রহণ করতে পারে। ফলে জমিতে নাইট্রোজেন বা ইউরিয়া সারের ব্যবহারের পরিমান খুবই কম করলেই চলে।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার শ্যামনগর গ্রামের কৃষক রবিউল ইসলাম জানান, স্থানীয় কৃষি অফিসারের পরামর্শে আমন ধানে লোগোসহ সারিতে রোপণ এবং জমিতে ধান রোপণের পরপরই ধৈঞ্চা ও জমিতে গাছের ডালপুতে পার্চিং তৈরি করে সফলভাবে পোকা দমন করা সম্ভব হয়েছে। যেখানে কীটনাশক ব্যবহার না করলেও চলে বলে তিনি মনে করেন। একই গ্রামের কৃষক জামাল হোসেন জানান, জমিতে ডালপুতে পার্চিং তৈরি করতে কৃষকদের কোনো খরচ হয় না। শুধুমাত্র ইচ্ছে থাকলেই এটা করা সম্ভব। অথচ কেনো প্রকার কীটনাশক ছাড়াই আবার অর্থ খরচ না করে ধানের জমির ক্ষতিকর পোকা সফলভাবে দমন হচ্ছে।
এ বিষয়ে সদর উপজেলার মধুুহাটি ব্লকের উপসহকারী কৃষি অফিসার মেসবাহ আহামেদ বলেন, উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা স্যারের নির্দেশে আমার ব্লকে রোপা আমন ধান লোগোসহ লাইন করে রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রায় শতভাগ জমিতে গাছের ডাল ও অফ্রিকান ধৈঞ্চা গাছ ব্যবহার করে পার্চিং তৈরিতে সক্ষম হয়েছি। শুধুমাত্র কৃষকদের সচেতনা বৃৃদ্ধি কারণেই চাষ পদ্ধতি ও কৃষি উপকরণ ব্যবহারে সম্ভব হয়েছে বলে তিনি মনে করেন ।
ওয়াড়িয়া গ্রামের কৃষক আকরাম হোসেন জানান, বেগুন ক্ষেতে তিনি ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করেছেন। ফেরোমন ট্র্যাপের কারণে ডোগা বা ফল ছিদ্রকারী পোকা ফেরোমন ট্র্যাপের যে বয়ামের মধ্যে হুইল পানি ব্যবহার করা হয় সেখানে এই পোকাগুলো পড়ে মারা যাই। তাই সাধরণত বেগুনে যে পরিমাণ ওষুধ কৃষক ব্যবহার করে তার কয়েক গুণকম ব্যবহার করে বেগুনচাষ করা সম্ভব।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা ড. খাঁন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, একই জমিতে উপর্যপরি রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির বৈশিষ্ট ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফলে মাটির অম্লতা নষ্ট হচ্ছে, পানি ধারণ ক্ষমতা কমছে এবং অনুজৈবিক কার্যাবলি ব্যহত হচ্ছে। এতে মাটির উৎপাদন ক্ষমতা দিনদিন কমে যাচ্ছে। সে কারণে জৈব এবং প্রানিজ সার ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বন্যা ও ক্ষরা সহনশীল জাতের বীজ ব্যবহার, লাইন লগো পদ্ধতি, কীটনাশকের বিকল্প হিসেবে পার্চিংয়ের ব্যবহার কারানো হচ্ছে। যেখানে কৃষক সম্পূর্ণ বিনা খরচে ক্ষতিকর পোকা দমন করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। তাই এই পদ্ধতি ব্যবহারে কৃষকরা দারুনভাবে উদ্বুব্ধ হচ্ছেন।