দর্শনায় স্থলবন্দর সম্ভাবনাময় রাজস্ব ক্ষেত্র

হারুন রাজু: এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্মাচিত হওয়া অগ্রগতির পথে বহুধাপ পেরিয়ে মাথা উঁচু করেছে বাংলাদেশ। জলে-স্থলে-আকাশ সব পথেই দেশের অগ্রগতির ছোঁয়া। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে এই অগ্রগতি দেশের। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে থাকা দর্শনাতেও লেগেছে সে অগ্রগতির ছোঁয়া। চলছে অবকাঠামোগত উন্নয়ন। সে লক্ষ্যেই গত ১২ জুলাই দর্শনায় ছুটে যান বাংলাদেশ সরকারের অভ্যান্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান। ওই সময় দর্শনা অডিটেরিয়াম কামকমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত মতবিনিময়সভায় নজিবর রহমান বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিত দিক নির্দেশনায় দর্শনায় পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নে যা করণীয়, তা খুবই দ্রুত করা হবে। এরপর থেকেই সবমহলে তোড়জোড় শুরু হয়েছে। রেলওয়ে ওয়াগনের পাশাপাশি সড়ক পথে ট্রাকযোগে দর্শনাÑগেদে সীমান্ত পথে পণ্য আমদানিÑরফতানির মাধ্যমে স্থল শুল্ক স্টেশন দর্শনায় একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালু হবে অচিরেই। এতে ভারতেরও প্রচ- আগ্রহ রয়েছে বলে জানা গেছে। পুরো অঞ্চলটি ঘিরে বাংলাদেশ-ভারতের প্রস্তুতি ইতোমধ্যে ভারত তাদের কাঁটাতারের বেড়ার বাইরের মাত্র ৮শ মিটার অংশে রাস্তা, বন্দরের টোলঘর নির্মাণের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের সাড়ে চার কিলোমিটার শামসুল ইসলাম স্থলবন্দর সড়ক প্রশ^স্ত করণে দুই কোটি টাকার ওপরে প্রাক্কলন প্রস্তুত করেছে এলজিইডি। দ্রুত সে টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে পারে। কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন হওয়ার পরেই দর্শনাÑগেদে সীমান্ত পথে ট্রাক যোগে পণ্য আমদানিÑরফতানির কার্যক্রম শুরু হবে।
স্থলবন্দর ঘোষণা: চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা স্থল শুল্ক স্টেশনকে ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি স্থলবন্দর ঘোষণা করা হয়। উদ্দেশ্য হলো- এ সীমান্ত দিয়ে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সম্প্রসারণ সহজ করা। বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন: বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ইংরেজরা রেলগাড়ি চালু করে। তখন ভারতের কোলকাতা থেকে বাংলাদেশের দর্শনা হয়ে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়। দর্শনা থেকে জগতি পর্যন্ত ৫৩ দশমিক ১১ কিলোমিটার রেললাইন-ই হলো বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা। দর্শনা বাংলাদেশের প্রথম রেলওয়ে স্টেশন স্থাপন করা হয়। বর্তমানে এটি আর্ন্তজাতিক রেলস্টেশন। আন্তর্জাতিক চেকেপোস্ট: দর্শনার জয়নগরে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট। এখানে গড়ে প্রতিদিন দুই হাজার পাসপোর্টধারী যাত্রী বাংলাদেশ-ভারত যাতায়াত করে থাকেন। ভারত-বাংলাদেশ টেলিকমিনিউকেশন: বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে যে টেলিযোগাযোগ চালু হয়েছে তার আন্ডারগ্রাউন্ড কেবল রুট দর্শনা সীমান্ত দিয়ে সংযুক্ত হয়েছে। আন্ডারগ্রাউন্ড কেবলের মাধ্যমে দর্শনা জয়নগর-গেদে রুট দিয়ে এ টেলিকমিউনিকেশন চালু হয়েছে দু বছর আগে। মৈত্রী ট্রেন: ভারত বাংলাদেশ অর্থাৎ ঢাকা-কোলকাতার মধ্যে একমাত্র চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস চলাচল করে দশর্না-গেদে রুটে। ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল থেকে এ রুটে সপ্তাহে ৬ দিন চলছে মৈত্রী ট্রেন। আভ্যন্তরীণ রেলস্টেশন: দর্শনায় রয়েছে ‘দর্শনা হল্ট’ নামের একটি আভ্যন্তরীণ রেলস্টেশন। এ রুটে খুলনা টু ঢাকা, রাজশাহী, সৈয়দপুর, রাজবাড়ী-গোয়ালন্দ দৈনিক ১০টি ট্রেন যাতায়াত করে। এশিয়ার বৃহত্তম চিনি কারখানা: এশিয়া দ্বিতীয় বৃহত্তম চিনিকল ও ডিস্টিলারি (দেশি ও বিলাতি মদ উৎপাদন কারখানা) ব্রিটিশদের তৈরি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি রয়েছে দর্শনায়। জৈব সারখানা: ভারতের কারিগরি সহায়তায় তৈরি সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের একমাত্র জৈব সার কারখানা রয়েছে দর্শনায়। আধুনিক রাজস্ব একাডেমি: কাস্টমসের ৪৪ বিঘা জায়গার ওপর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হতে যাচ্ছে আধুনিকমানের রাজস্ব একাডেমি। যা হবে দর্শনায় অবকাঠামো উন্নয়নের উজ্জ্বল নক্ষত্র। স্থল শুল্ক স্টেশন: দর্শনায় ১৯৬২ সাল থেকে রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম শুরু হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সর্বশেষ প্রজ্ঞাপন মোতাবেক ভারত থেকে রেলপথে দর্শনা শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমে গবাদিপশু, মাছের পোনা, তাজা ফলমূল, গাছগাছড়া, বীজ গম, পাথর, কয়লা, রাসায়নিক সার, চায়না ক্লে, কাঠ টিম্বার, চুনাপাথর, পিয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, বলক্লে, কোয়ার্টজ, চাল ভূষি, ভুট্টা, বিভিন্ন প্রকার খৈল, পোল্ট্রি ফিড, ফ্লাই অ্যাশ, রেলওয়ে স্লিপার, বিল্ডিং স্টোন, রোড স্টোন, স্যান্ড স্টোন, বিভিন্ন প্রকার ক্লে, গ্রানুলেটেড স্লাগ ও জিপসাম আমদানি এবং সকল প্রকার পণ্য রফতানির অনুমোদন আছে। কিন্তু এক্ষেত্রে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের নিয়মানুযায়ী ৪২টি রেলওয়ে ওয়াগনে করে একটি র‌্যাক আকারে পণ্য আমদানি করতে হয় (১টি র‌্যাক সমান ৪২টি ওয়াগন পণ্য বোঝাই)। ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও স্থল পথের যোগাযোগ না থাকায় স্বল্প পরিমাণ পণ্যের আমদানিকারকদের পক্ষে পণ্য আমদানি করা সম্ভব হয় না। তাই রেলপথের পাশাপাশি সড়ক পথের সংযোজন হলে দর্শনা একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরের মতো অন্যান্য বন্দরের ন্যায় ট্রাকযোগে পণ্য আমদানি-রফতানির সক্ষমতা অর্জন করবে এবং রাজস্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রসারিত হবে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সংযোজন: পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর বাস্তবায়নে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলো চুয়াডাঙ্গার দর্শনা বন্দর। দর্শনা স্থল বন্দরে আমদানি-রফতানির সকল পদ্ধতি ডিজিটাল সুবিধার আওতায় আনা হলো। দর্শনা স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশনে চালু করা হলো অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড। ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি দর্শনা শুল্ক স্টেশনে অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়েছে। এর ফলে দেশের যেকোনো বন্দর থেকে মুহূর্তেই দর্শনা বন্দরের আমদানি-রফতানিকৃত সকল পণ্যেও এসএম কোড ও মূল্য নির্ধারণ সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা। এতে দর্শনা বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানির সুবিধা আরও ত্বরান্বিত হবে। অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড -মূলত একটি সফটওয়্যার সার্ভার। বর্তমানে বিশ্বের একশোর ও বেশি দেশে এই সফটওয়্যারটি চলে। বাংলাদেশে চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। চট্টগ্রাম, টেকনাফ, মংলা, বেনাপোল বন্দরের পর এবার দর্শনা বন্দরে চালু হয়েছে এটি। ফলে দেশের যেকোন বন্দর থেকে মুহূর্তেই দর্শনা বন্দরের আমদানি-রফতানিকৃত পণ্যের এসএম কোড ও মূল্য নির্ধারণ সুবিধা পাবেন ব্যবসায়ীরা। রাজস্ব আয়ে দর্শনা: ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দর্শনা থেকে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে সরকার। এর মধ্যে স্থল শুল্ক স্টেশন ৬০ কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৬৯ কোটি ৪০ লাখ ১৫ হাজার ৩১৮ টাকা রাজস্ব আয় করেছে। এছাড়াও দেশের ঐতিহ্যবাহী চিনিকল দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে সরকারি কোষাগারে ৬২ কোটি টাকা রাজস্ব প্রদান করেছে। আর রেলওয়ে দর্শনা স্টেশন থেকে আয় করেছে ৪৩ কোটি টাকা। পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠায় অবকাঠামো সুবিধা: চুয়াডাঙ্গা জেলাধীন দামুড়হুদা উপজেলার অন্তর্গত একটি সীমান্ত শহর। দর্শনা ১৯৯১ সালে পৌরসভায় উন্নীত হয়। বর্তমানে ২য় শ্রেণির পৌরসভা এটি। এখানে আছে একটি আন্তর্জাতিক রেল স্টেশন, একটি আভ্যন্তরীণ রেল স্টেশন, একটি রেলওয়ে জংশন (বর্তমানে রেলওয়ে অপারেশন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে), একটি ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, বিজিবির ছয়টি বিওপি ক্যাম্প সংবলিত একটি কোম্পানি সদর ক্যাম্প, প্লান্ট কোয়ারেনটেইন অফিস, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা, ডাচবাংলা ব্যাংকের শাখা আছে। পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের পাশেই অবস্থিত কাস্টমস এর নিজস্ব ৪৪ বিঘা জায়গার উপর একটি বিশাল কাস্টমস কমপ্লেক্স, যেখান থেকে স্থল শুল্ক স্টেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া কাস্টমস কমপ্লেক্সে পাশেই রয়েছে একটি ডাকবাংলো, একটি পৌর অডিটোরিয়াম, বিটিসিএল অফিস, একটি সরকারি কলেজ ও একাধিক আধা-সরকারি/বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরিবহন টার্মিনাল: স্থলপথে সংযোগের মাধ্যমে ট্রাকযোগে পণ্য আমদানি-রফতানি হলে পরিবহন টার্মিনাল এবং বন্দরের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের জন্য জয়নগর চেকপোস্টের অদূরে বাংলাদেশ অংশে অধিগ্রহণ করার মতো পর্যাপ্ত জমি আছে। দর্শনা জয়নগরে প্রস্তাবিত বন্দর টার্মিনাল নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও এসেছে অভূতপূর্ব উন্নয়ন। দর্শনা থেকে দৈনিক ৪০টি যাত্রীবাহী কোচ হাইওয়ে রোড দিয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম যাতায়াত করে এবং রেলপথে খুলনা টু ঢাকা, রাজশাহী, সৈয়দপুর, রাজবাড়ি-গোয়ালন্দ দৈনিক ১০টি ট্রেন যাতায়াত করে। দশর্না-গেদে রুটে একমাত্র চলাচলকারী যাত্রীবাহী ট্রেন মৈত্রী এক্সপ্রেস চলছে সপ্তাহে ছয়দিন। জয়নগর আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট থেকে দর্শনা স্থল শুল্ক স্টেশনের দূরত্ব মাত্র সাড়ে ৩ কিলোমিটার। জয়নগর আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট থেকে ভারতের গেদে এলসি স্টেশনের দূরত্ব মাত্র ৮০০ মিটার। জয়নগর চেকপোস্ট দিয়ে দৈনিক গড়ে দুই হাজার যাত্রী ভারতে গমনাগমন করেন। ভারতের সাথে সড়ক পথের সংযোজন হলে স্থলবন্দরের মালবাহী ট্রাক যাতায়াতের জন্য ঢাকা দর্শনা হাইওয়ে রোড থেকে জয়নগর চেকপোস্ট পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার পাকা রাস্তা দৃশ্যমান। রেলপথের পাশাপাশি সড়কপথের যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দর্শনা স্থল শুল্ক বন্দর একটি পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে রূপান্তরিত হলে চাহিদা মোতাবেক পণ্য আমদানি-রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশের যেকোনো বৃহৎ স্থলবন্দরের অর্জিত রাজস্বের চেয়ে অধিক রাজস্ব অর্জন করা সম্ভব হবে বলে স্থানীয় ব্যবসায়ী মহলের দাবি।