নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা : বসছে চেকপোস্ট, বাড়ছে নজরদারি

রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে

স্টাফ রিপোর্টার: টেকনাফ ও উখিয়ার উপকূলবর্তী আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ভাতের হাহাকার, পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাব এবং মিয়ানমারে পুশব্যাকের ভয়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের জন্য নির্ধারিত গণ্ডি ছেড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করেছে। এ কাজে তাদের সহায়তার নামে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মানুষ রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন বাণিজ্য ফেঁদে বসেছেন। দালালরা তাদের নিকটাত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন কর্মব্যস্ত শহরে শ্রমজীবী মানুষের ভিড়ে তাদের মিশিয়ে দেয়ার অপতৎপরতা মেতেছেন। এতে গোটা দেশ নতুন করে নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যদিকে মিয়ানমার থেকে আসা সাধারণ শরণার্থীদের সাথে সেখানকার সন্ত্রাসীরা অস্ত্র- গোলাবারুদ কিংবা মাদক নিয়ে দেশে ঢুকছে কি-না তা নিয়েও শঙ্কা বাড়ছে। গোয়েন্দারা বলছেন, যেভাবে দুর্গম সীমান্ত ও নাফ নদী পার হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা আসছে তাতে তাদের ভিড়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নির্বিঘ্নে অস্ত্র-মাদকের বড় চালানও পাচার হতে পারে। আর এমনটি ঘটলে দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হবে। উদ্বিগ্ন এ পরিস্থিতি সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। শরণার্থী রোহিঙ্গারা যাতে আশ্রয় শিবির ছেড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য সেখানে কড়া নজরদারির পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নগরীর কালুরঘাট ও শাহ আমানত সেতুতে চেকপোস্টের মাধ্যমে নজরদারি শুরু হয়েছে। তবে রোহিঙ্গারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত বিধায় তাদের ধরা কঠিন হয়ে পড়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগী শহরগুলোর প্রবেশমুখেও একাধিক তল্লাশি চৌকি বসানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসার সময় যাতে অস্ত্র-মাদকের চালান নিয়ে এদেশে ঢুকতে না পারে এ জন্য সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি এবং কোস্টগার্ডকে সতর্ক করা হয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর হামলার ঘটনাকে পুঁজি করে যাতে কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গোয়েন্দাদের বিশেষ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। নির্দেশনা অনুযায়ী এরই মধ্যে নতুন করে মিয়ানমার দূতাবাস ও বৌদ্ধ মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা বাড়ানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদের নামে বিক্ষোভ কর্মসূচির সুযোগ নিয়ে কোনো গোষ্ঠী যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে সে বিষয়েও থানা পুলিশকে অ্যালাট করা হয়েছে। এছাড়া ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ভুয়া সংবাদ এবং এ সংক্রান্ত ভিডিও ক্লিপ ছড়িয়ে কেউ যাতে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করতে না পারে এজন্যও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে গোয়েন্দাদের দেয়া প্রতিবেদনে অতীতের বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ এবং তা নিয়ে বিভিন্ন দেশে ঢুকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে আগাম সতর্কতা অবলম্বনের জন্যও গোয়েন্দারা সুপারিশ করেছেন। পাশাপাশি স্থানীয় কোনো জনপ্রতিনিধি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সনদ দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে অতীতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে যেসব অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করেছে, এবার তারা যাতে সে ধরনের কোনো সুযোগ না পায় সে ব্যাপারে আগাম সতর্ক থাকার সুপারিশ করা হয়েছে।

এদিকে সব কিছুর ওপরে উঠে এসেছে মিয়ানমারের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-এর নাম। এ সংগঠনটি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাতে কোনো অপতৎপরতায় লিপ্ত হতে না পারে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার সুপারিশ করেছে গোয়েন্দারা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবির ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কক্সবাজার প্রশাসন সরাসরি স্বীকার না করলেও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অবাধে চলাফেরা করছে। এখন নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারাও মিশে যাচ্ছে বাংলাদেশিদের সাথে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের ভাষা, পোশাক, চলাফেরা ও সংস্কৃতির সাথে মিল থাকায় তাদের মিশতে মোটেও সমস্যা হচ্ছে না।

তারা জানান, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পর প্রথমে উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। দু-একদিন সেখানে অবস্থানের পর সুযোগ বুঝে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। বিশেষ করে গত কয়েকদিন ধরে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প থেকে সপরিবারে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। তবে এ জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আশ্রয় শিবিরের অভাব-অনটনকে দায়ী করেন। তারা বলেন, রোহিঙ্গারা অনেকে দিনের পর দিন না খেয়ে থাকছে। একপর্যায়ে তারা বেঁচে থাকার তাগিদে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ সংকট দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে কক্সবাজারের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।

কক্সবাজার ও টেকনাফ এলাকা থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন গন্তব্যের দূরপাল্লার পরিবহনের চালক ও সুপারভাইজাররা জানান, আগস্টের শেষ সপ্তাহ থেকে এ পর্যন্ত অন্তত দুইশ রোহিঙ্গা তাদের বাসে সাওয়ার হয়েছেন। তাদের কেউ কেউ চট্টগ্রাম শহরে আবার কেউবা সেখানে পৌঁছানোর আগেই পথে নেমে গেছেন। এদের কেউ কেউ আবার ঢাকার পথেও পাড়ি দিয়েছেন। চেহারায় চেনা না গেলেও তাদের আলাপচারিতায় তা স্পষ্ট বোঝা গেছে। তবে বুধবার থেকে চট্টগ্রাম শহরের প্রবেশমুখে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসার পর এ প্রবণতা অনেকটাই কমেছে বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা।

ঢাকা-টেকনাফ রুটে চলাচলকারী এসএ পরিবহনের শ্রমিক খোকন জানান, এসব রোহিঙ্গার সাথে স্থানীয় দালালদেরও দেখা গেছে। যদিও তারা তাদের আত্মীয় বলে দাবি করেছেন। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু চেকপোস্ট বসিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ছড়িয়ে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন বলেও মনে করেন খোকন। এদিকে শরণার্থী রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র দেয়ার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিত করে রাখা যাবে কি-না তা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনই সংশয় প্রকাশ করেছে। প্রশাসনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের ভাষ্য, রোহিঙ্গারা কোনো অপরাধে জড়ালে তাকে শনাক্ত করতে ওই পরিচয়পত্র কাজে লাগবে এমন ধারণা থেকে এ উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। কেননা, অপরাধী ধরা পড়ার পরই শুধুমাত্র তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা দেড় লাখ শরণার্থীর বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্র আদৌও স্বল্প সময়ের মধ্যে দেয়া সম্ভব হবে কি-না তা নিয়েও সন্দিহান প্রশাসনের অনেকেই। এদিকে মিয়ানমার থেকে অবাধে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ফলে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, সম্প্রতি যারা দেশে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের অধিকাংশই নারী এবং শিশু। এদের বহরে পুরুষের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। আর এটিই সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। কেননা, এসব পরিবারের পুরুষ সদস্যরাও পর্যায়ক্রমে দেশে ঢুকবে। তাদের সাথে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে। যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদারের মতে, এটি বাংলাদেশের জন্য বহুমাত্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তাজনিত সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে। দিন যতো যাচ্ছে তা ততোই জটিল হচ্ছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগাযোগ ও সহযোগিতা শুরু থেকেই আছে। শরণার্থীদের আড়ালে ও অজুহাতে পাকিস্তান, মধ্যপ্রাচ্য ও লন্ডনভিত্তিক কট্টরপন্থি ইসলামিস্ট সংস্থাগুলোর সোথে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলো সহজেই সংযোগ স্থাপনের সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের জঙ্গিরাও এই সুযোগটি তাদের বৈদেশিক লিঙ্ক রক্ষার জন্য কাজে লাগাতে পারে। এছাড়াও বিয়েশাদির কারণে এবং অবৈধ পথে অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ও পেয়ে যাচ্ছে। এসব প্রবণতা দ্রুত রোধ করতে না পারলে একসময় কক্সবাজারের চারটি সংসদীয় আসনের নির্বাচনের ফল নির্ধারণে রোহিঙ্গারা অনুঘটকীয় ভূমিকায় চলে আসবে। তখন সমস্যা আরও জটিল হবে। দিন যতো যাবে ততোই এটি বাংলাদেশে ভূখণ্ডীয় নিরাপত্তার জন্য জটিল ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলে মনে করেন মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী শিকদার।