সভ্য যুগে কেন সেই অসভ্যতার হাতছানি

হাতেনাতে চোর ধরেও যখন মারপিট করা অন্যায়, তখন চালপড়া খাইয়ে শুধুমাত্র সন্দেহের বসে মেরে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা কতোবড় অপরাধ? এরপর যদি অপরাধীর পক্ষ নেয় পুলিশ, তখনও কি বলতে হবে সমাজের সব কিছু ঠিকঠাকভাবেই চলছে? নাকি বলতে হবে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সফল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে? অবস্থাদৃষ্টে লজ্জায় মাথানিচু করা ছাড়া বিবেকবানদের আর কিই বা করার আছে? না, লজ্জায় নিজেদের আড়াল করলেও ভবিষ্যতের কাঠগড়া নিশ্চয় ছাড়বে না।

চালপড়া খাওয়ানোর নামে এক সময় চালাকি করে চোর ধরার ফাঁদ পাতা হতো বটে, সেটা বহুদিন আগেই সেকেলে হয়ে গেছে। কেননা, চোরও জেনে গেছে, ভয়ে মুখের লালা শুকিয়ে আসে বলেই সন্দেহটা তার ওপরই গিয়ে পড়ে। তাহলে এখনও চালপড়া খাওয়ানো কেন? কোন ওঝা চাল পড়ে দেয়? যে ওঝা বা কবিরাজ চাল পড়ে তাকে যেমন ধরে আইনে সোপর্দ করা দরকার, তেমনই দরকার চাল পড়া খাওয়ানোর পর শুধুমাত্র অনুমান নির্ভর হয়ে মারপিট করে স্বীকারোক্তি আদায়ের অপচেষ্টায় মেতে ওঠে, নির্মম নির্যাতন করে তাদেরও উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। অথচ চুয়াডাঙ্গা সদর থানা পুলিশ নির্যাতন নয়, নির্যাতনের শিকার দুজনকেই ধরে গারদে রেখেছে। গতকাল দৈনিক মাথাভাঙ্গা পত্রিকায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন পাঠমাত্রই প্রশ্ন জাগা খুবই সঙ্গত, পুলিশও কি তাহলে এখন চালপড়ায় বিশ্বাস করে? চোর স্বীকার করলেও তো তাকে চালপড়া খাওয়ানো ও মারপিট করার জন্য নির্যাতনকারীদের ধরে আইনে সোপর্দ করা উচিত। চালপড়া খাওয়ানো যেহেতু অন্যায়, সেহেতু অন্যায়কারীদের প্রশ্রয় দিলে সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠা দূরাস্ত অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় কি দস্তুর নয়?

এক সময় বাঁশের কাবারি বা চটাচালান, কাঁসাবাটি চালানের নামে প্রভাবশালীরা সমাজের পিছিয়ে পড়া কিম্বা নিম্নবর্ণের তকমার জালে আটকানো নিপিড়িতদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে নিজেদের ক্ষমতার জাহির করতো। অনেক কিছুতেই বাধ্য করাও হতো তখনও নানা অজুহাতে ওঝা কবিরাজ ডেকে। চালপড়াও সেই প্রভাবশালীদেরই সেই সময়ের একধরনের প্রতারণার অস্ত্রও। তা দিয়ে চালাকির মাধ্যমে চোর যেনতেন, মেধার বিকাশ ঘটানো ছেলেকে সমাজের সামনে বেঁধে পেটানও ছিলো তখনকার সময়ে মতলববাজদের কৌশলের অংশ। চালপড়া সত্যিই যে প্রকৃত চোরের গলা আটকায় তার যথার্থ প্রমাণ কখনোই মেলনি। ধরা পড়ে যাচ্ছি ভেবে চোর যদি ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে সেক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। তবে চালপড়ার নামে সহজ এই চালাকি যখন চোরও বুঝে যায় তখন চোরও তো সহজেই সাধুসাজে। তাছাড়া চালপড়া খাওয়ানো এবং সন্দেহের বশে কাউকে চোর বলে সাব্যস্ত করা মানেই অন্যায়ভাবে অপবাদ দেয়া। অপবাদের লজ্জা যেমন বড়ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, তেমনই অপবাদ সুপথে থাকা একজনকে প্রতিহিংসা পরায়ণতায় ভয়ঙ্কর অপরাধীও করে তুলতে পারে। তাহলে সভ্য যুগে কেন সেই অসভ্যতার হাতছানি। কেনই বা অসভ্য আচরণকারীদের পক্ষে পুলিশের অবস্থান? বিষয়টি সুষ্ঠু তদন্তের দাবি রাখে।

চালপড়া খাইয়ে চোর ধরার নাটকের মতো অন্যায় প্রকাশ্যে হলেও সমাজের একজনও কি তার প্রতিবাদ করে না? করবে কীভাবে? অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে অনেক সময়ই দলভুক্ত অন্যায়করা এতোটাই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে যে, প্রতিবাদকারীর মর্যদা রক্ষাই দায় হয়ে পড়ে। সমাজে খারাপগুলো দলভুক্ত আর ভালোর সংখ্যা বেশি হলেও এরা অসংগঠিত বলেই প্রকাশ্যে অন্যায়ের যেন ধুম পড়েছে। না, আর নয় দেশাচার বা গড্ডালিকায় গা ভাসানো। অন্যায় রোধে দরকার সচেতনদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা।