রাজনীতিতে ভোটের হাওয়া : প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে সব দল

 

তৃণমূলে তীক্ষ নজর রাখছেন দলীয় প্রধান থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী মহল

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে ইতিমধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ২০১৮ সালের শেষভাগে অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচন  সব দলের অংশগ্রহণে ব্যাপক প্রতিযোগিতামূলক হবে এমনটা ধরে নিয়ে নির্বাচনী মাঠে নেমে গেছে রাজনৈতিক দলগুলো। নিজ নিজ কৌশলে ঘর গোছানোর পাশাপাশি জোর প্রস্তুতি চলছে ভোটযুদ্ধের। ভোটারদের কাছে টানতে নেয়া হচ্ছে নানা কর্মসূচি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ের কাজও এগিয়ে চলছে। নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তৃণমূলে তীক্ষ্ম নজর রাখছেন দলীয়প্রধান থেকে শুরু করে দলের নীতিনির্ধারণী মহল। সব মিলিয়ে সবাই এখন নির্বাচনমুখী।

ভোটের চিন্তা মাথায় রেখে মিত্র বাড়ানোর পথে হাঁটছে সব দলই। জোট ভাঙছে। আবার নতুন জোট হচ্ছে। নানা কারণে দীর্ঘদিন দূরে থাকা নেতাদের দলে টানা হচ্ছে। তবে নির্বাচনী মাঠে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। এখন চলছে প্রচার ও ইশতেহার তৈরির কাজ। দলীয় মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতাদের নির্বাচনী দিকনির্দেশনার পাশাপাশি সফরকালে দলীয় প্রতীক নৌকায় ভোট চাচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলের হাইকমান্ডের নির্দেশনা পাওয়ার পর বর্তমান সংসদ সদস্যসহ মনোনয়ন প্রত্যাশী সাড়ে ৩ হাজার প্রার্থী অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন তৃণমূলে। তারা একদিকে প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে সরকারের ব্যাপক উন্নয়ন ও সাফল্যের চিত্র তুলে ধরছেন, অন্যদিকে বিএনপির অপপ্রচারের জবাব দেয়া শুরু করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এসব প্রচারণা চলছে।

অন্যদিকে, নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নির্বাচনসহ রাজনীতির নানাদিক সংবলিত ‘ভিশন-২০৩০’ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ৩শ’ আসনে ৯শ’ প্রার্থী প্রস্তুত বলেও জানিয়েছেন দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনী মাঠে ক্রমেই সরব হচ্ছে। বিশেষ করে জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ ৫৮ দলের সমন্বয়ে ‘সম্মিলিত জাতীয় জোট’ নামে বিশাল এক জোট করেছেন। পাশাপাশি দুই বড় জোটভুক্ত ও জোটের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল নিজেদের মতো করে নির্বাচনী প্রস্তুতির কাজ করছে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের পর ২৯ জানুয়ারি সংসদের অধিবেশন প্রথম বসে। এই হিসেবে ২৯ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাত্ ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সংবিধানের ১২৩(৩) ধারা অনুসারেও মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা রয়েছে।

নির্বাচনী প্রস্তুতিতে আওয়ামী লীগের তোড়জোড় বেশি দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত রোববার সংসদীয় দলের বৈঠকেও প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এখন থেকেই নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামার জন্য দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী নির্বাচন কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করিয়ে দিয়ে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, জনপ্রিয়তা ছাড়া কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না। এলাকায় দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করারও নির্দেশ দেন তিনি। এমনকি ওই বৈঠকে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে স্বতন্ত্র ১১ সংসদ সদস্যকেও নতুন মনোনয়নের জন্য মনোযোগ দিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়।

মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলে জনপ্রিয়তা অন্যতম মাপকাঠি-হাইকমান্ডের কাছ থেকে এমন বক্তব্য আসায় নির্বাচনী প্রচারণায় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যারা দীর্ঘদিন একজন আরেকজনের মুখ দেখতেন না, তারাও এখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড জনগণের সামনে তুলে ধরছেন।

সূত্র জানায়, আগামী জুন মাসে দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযান ফের শুরু হবে। দলকে সুসংগঠিত করতে আগামী নভেম্বর মাসেই জেলায় জেলায় জনসংযোগে নামবেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। সরকারের উন্নয়ন ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতা তুলে ধরার পাশাপাশি বিরোধী শক্তির নেতিবাচক কর্মকান্ড তুলে ধরবেন তিনি।

সূত্র জানায়, দলে নির্বাচনের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি চলছে। ২২ এপ্রিল থেকে জেলা নেতাদের দলীয় সভানেত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডেকে অভ্যন্তরীণ ভেদাভেদ মিটিয়ে ফেলতে বলা হচ্ছে। দলের সিনিয়র নেতারাও গণসংযোগ শুরু করে দিয়েছেন। মনোনয়নের জন্য এখন থেকেই দেয়া হচ্ছে সতর্ক বার্তা। দলের তৃণমূলকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং নির্দেশনা দিতে ২০ মে সব জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের পাশাপাশি প্রচার, দফতর, তথ্য ও গবেষণা এবং উপ-প্রচার ও উপ-দফতর সম্পাদকদের সাথে বৈঠক করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

সূত্র জানায়, সারাদেশে তিনশ’ আসনে সাড়ে ৩ হাজার প্রার্থী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশী। প্রতিটি আসনের জরিপ রিপোর্ট ও প্রকৃত চিত্র দলের হাইকমান্ডের কাছে আছে। নির্বাচনী এলাকায় কার কী অবস্থা, জনসমর্থন কার কেমন, আর কারা জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন- সব রিপোর্ট শেখ হাসিনার টেবিলে। মনোনয়ন দেয়ার আগে আরো জরিপ চালাবেন শেখ হাসিনা। এক্ষেত্রে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামত প্রাধান্য পাবে। যারা জনগণের সমর্থন ধরে রাখতে পেয়েছেন তারাই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। জনবিচ্ছিন্ন কাউকেই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর হুশিয়ারির পর অভ্যন্তরীন কোন্দল ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামা শুরু করেছেন নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ফোন করে দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থেকে নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। বর্তমান এমপিদের মধ্যে একটা দুশ্চিন্তা ভর করেছে। তবে তৃণমূল নেতাকর্মীরা দলের হাইকমান্ডের এই সতর্কতায় উজ্জীবিত, তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উচ্ছ্বাস। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন এমন ৫ জন সংসদ সদস্য তাদের দুশ্চিন্তার কথা জানিয়ে বলেন, ‘এমপি হিসেবে তৃণমূলে জনপ্রিয় হওয়া খুবই কঠিন। কারণ এমপিদের কাছে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের চাওয়া-পাওয়ার কোনও সীমা নেই। কিন্তু আমাদের ক্ষমতা অসীম নয়, তাই সব চাওয়া পূরণ করা সম্ভব হয় না। সংসদ সদস্যদের জনপ্রিয় হওয়া অনেক কঠিন। মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলের কাছে জনপ্রিয়তাই যদি একমাত্র মানদন্ড হয়, তাহলে একজন এমপিও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি জনপ্রিয়।

অন্যদিকে তৃণমূলের ত্যাগী নেতারা বলেন, ‘তৃণমূল নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দিয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য সময়োপযোগী ও সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ নেতাকর্মীদের সাথে সময় দেয়া তো দূরে থাক, অনেক সংসদ সদস্য আছেন ঢাকা ছেড়ে এলাকায় আসেননি গত ৩ বছর। দলের নেতাকর্মীদের জেলে বন্দি হওয়ার পেছনেও অনেক এমপির ষড়যন্ত্র আছে। অন্তত ৩০টি জেলায় পাওয়া যাবে এমন নজির।’

আওয়ামী লীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জানান, ‘মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তৃণমূলে জনপ্রিয়তাকে ধরা হবে অন্যতম মাপকাঠি। এটাই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তার সাফ কথা, জনবিচ্ছিন্ন কাউকে মনোনয়ন দেয়া হবে না আগামী নির্বাচনে। এই হুঁশিয়ারি অনেক এমপির মধ্যে দুশ্চিন্তার সৃষ্টি করেছে। তবে কাজ দেখিয়ে অবস্থান সুসংহত করার সময় এখনো আছে।’

ঈদের আগেই দল পুরোপুরি গোছানোর বার্তা বিএনপিতে: সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ঈদের আগেই দল গোছাতে সংশ্লিষ্ট নেতাদের বার্তা দিয়েছেন। এরই মধ্যে ৭৭টি সাংগঠনিক জেলার ৪০টির কমিটি দেওয়া হয়েছে। রমজানের আগে আরো ১০টি জেলা কমিটি গঠন করা হতে পারে। কিন্তু বিএনপির তৃণমূলের সাংগঠনিক অবস্থা এখনো বেহাল। আন্দোলনের ব্যর্থতার পর পুনর্গঠনকে কেনদ্র করেও বেশ কয়েকটি জেলা ও মহানগরে কোন্দল দেখা দেয়। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও বিভক্ত হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে তৃণমূলে ঐক্য ফেরাতে এবং নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে জেলাপর্যায়ে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্রীয়ভাবে গঠিত ৫১টি সাংগঠনিক টিম। দলকে চাঙা করতে কর্মিসভার পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে প্রস্তুতির বার্তাও দেওয়া হচ্ছে তৃণমূল নেতৃত্বকে।

দলীয় সূত্রগুলো জানায়, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির মূল কাজ ঘর গোছানো হলেও সেখানে পারছে না দলটি। দুই দফা সরকারবিরোধী আন্দোলনে মামলা-হামলা ও নির্যাতনে তৃণমূলের নাজুক সাংগঠনিক অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না পাওয়ায় নেতাকর্মীরা এখনো বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতিতে ভোটযুদ্ধের চূড়ান্ত লড়াইয়ে নামার আগে দলের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি এবং নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে দলটির হাইকমান্ডকে পরামর্শ দেন সংশ্লিষ্টরা। তৃণমূলকে চাঙা ও সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তৃণমূল সফরের জন্য ৫১টি কেন্দ্রীয় টিম করা হয়েছে। মূলত মাঠের চিত্র জানা এবং সে মতে কাজ করাই এর অন্যতম লক্ষ্য। তবে আন্দোলন ও নির্বাচন সামনে রেখে নেতাকর্মীদের চাঙা করতে বিএনপির নেওয়া উদ্যোগ ঠিকমতো কাজ করছে না। নির্ধারিত সময়ে অর্ধেক জেলায়ও কর্মিসভা করতে পারেনি দলটি।

জাপার নতুন জোট: নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গড়া নতুন জোট নিয়ে রাজনীতিতে নানা ধরনের আলোচনা থাকলেও জাপা মনে করছে, ভবিষ্যতে আসন ভাগাভাগিতে কাজে লাগবে। দলের নেতারা বলছেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে যেকোনো মূল্যে আরেকবার ক্ষমতায় যেতে চান এইচএম এরশাদ। আর যদি তা সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে তিনি ক্ষমতার ভাগ কিংবা আমৃত্যু রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকতে চান। আর এসব চিন্তা থেকেই এই উদ্যোগ। তা ছাড়া আগামী নির্বাচনে কোনো কারণে যদি বিএনপি না আসে তখন বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার সুযোগ থাকবে। এ কারণে তিনি জোট গঠন করছেন বলে জানিয়েছেন এইচএম এরশাদের ঘনিষ্ঠরা।