মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা আম্রকানন ইতিহাসের সাক্ষী : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে নানা উদ্যোগ

মাজেদুল হক মানিক/শেখ শফি: ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণ করে মেহেরপুরের তৎকালীন বেদ্যনাথতলা আম্রকাননে। শপথ গ্রহণের পর সেই বৈদ্যনাথতলা হয়ে যায় ঐতিহাসিক মুজিবনগর। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গর্ববোধ করে অনেকেই। স্থানটিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এখানে গড়ে তুলেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা স্থাপনা। স্থানটি দর্শনার্থীদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে আগামীতে ৩৩০ কোটি টাকা ব্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা স্থপনা তৈরি করার পরিকল্পনা করছে সরকার।

১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ মুজিবনগরের ভবরপাড়ার ইপিআর ক্যাম্পের সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করতে কুষ্টিয়া চলে যায়। সে সময় ওই ক্যাম্পের রক্ষণাবেক্ষণের দয়িত্ব পায় ১২ আনসার সদস্য। ১৬ এপ্রিল সকালে তৎকালীন কুষ্টিয়া মহকুমার এসডিও তৌফিক এলাহি ওই আনসার সদস্যদের ডেকে বলেন, বৈদ্যনাথ তলার আম্রকাননে কিছু মেহমান আসবেন। গ্রামবাসীদের সহায়তায় বর্তমান মুজিবনগর স্মৃতিসৌধের স্থানে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কয়েকটি চৌকি এনে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়। ওইদিন রাতেই ভারতীয় ফোর্স এসে সেখানে অবস্থান নেয়। পরদিন সকালে ভারতের সীমানা পেরিয়ে বৈদ্যনাথ তলায় আসেন জাতীয় ৪ নেতা। সাথে আসেন দেশি-বিদেশি সাংবাদিক। সেখানে জাতীয় চার নেতা শপথ নেন এবং ১২ আনসার সদস্যের সাথে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। এরপর গার্ড পরিদর্শন করে আবাও চলে যান। এছাড়াও ওইদিন মঞ্চ তৈরি থেকে শুরু করে পানি ও অন্যান্য জিনিস সরবরাহে কাজ করেন সাধারণ মানুষ। এমনকি সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেছেন তারা। তাদের মধ্যে ওই দিনের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে অনেকেই। ফলে আজও ১৭ এপ্রিল নাড়ির টানে তারা ছুটে আসেন মুজিবনগরে। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গর্বিত তারা। এদিন সরকারি ছুটি ঘোষণাসহ নির্বাচিত সরকারের প্রথম অধিবেশন এ স্থানে আয়োজন করার দাবি তাদের। বলছিলেন সেদিনের গার্ড অব অনার প্রদানকারী আনছার সদস্য আজিমদ্দীন শেখ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক কিতাব আলী।

ঐতিহাসিক এ স্থানটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে স্মৃতিসৌধ। এর ২৩ টি স্তম্ভ দ্বারা বোঝানো হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৩ বছরের নির্যাতন। লাল মঞ্চটি বাংলাদেধের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান। অঙ্কিত বহু বৃত্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের বুদ্ধিজিবীদের মাথার খুলি, পাশের থরে-বিথরে সাজানো অসংখ্য পাথর ৩০ লাখ শহীদ ও ৩ লাখ মা বোনের আত্মত্যাগের প্রতীক। ১১টি সিড়ি উপজিব্য হয়েছে ১১টি সেক্টরের যুদ্ধ। প্রতিটি সৌধে রাখা হয়েছে অসংখ্য ফুটো। এগুলো বলছে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার কথা। এছাড়াও বিশাল মানচিত্রে ৯ মাসের যুদ্ধের প্রতিটি দৃশ্যই ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পাশেই রয়েছে ভাস্কর্য। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, আনছার সদস্যদের গার্ড অব অনার প্রদানের দৃশ্য, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, সেক্টর কমান্ডারদের বৈঠকসহ বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের দৃশ্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরা এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস জানতে পারে। এখানে আসলেই অনেকেই আপ্লুত হয়ে পড়ে। ইতিহাস জানার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ইতিহাস তুলে ধরার জন্য এটি একটি অন্যতম স্থান বলে মনে করেন দর্শনার্থীরা।

মুজিবনগর কমপ্লেক্স ঘিরে সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা বললেন মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য ফরহাদ হোসেন দোদুল। তিনি বলেন, স্থানটিকে ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য প্রায় ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এতে ২০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। যাতে একটি লেক, শিশুদের জন্য পার্কসহ থাকছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক নানা স্থাপনা।