তবুও প্রশ্ন রয়েই গেলো

 

নানা জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন তথা কুসিক নির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হলেন বিএনপি প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে ১১০৮৫ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেন। এবারের নির্বাচনে তিনি পেয়েছেন ৬৮,৯৪৮ ভোট। আর আঞ্জুম সুলতানা সীমা পেয়েছেন ৫৭,৮৬৩ ভোট। এর আগে ২০১২ সালে মনিরুল হক সাক্কু কুসিকের প্রথম নির্বাচনে ২৯ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও আঞ্জুম সুলতানার বাবা আফজাল খানকে।

এবারের কুসিক নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৬৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে অনিয়ম ও কেন্দ্র দখলের অভিযোগে দুটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত ঘোষণা করায় ২১ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদের ফলাফল ঘোষণা করা যায়নি। বাকি ২৫টি ওয়ার্ডের ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে ৯টিতে আওয়ামী লীগ, ৭টিতে বিএনপি, ৩টিতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী, জামায়াতে ইসলামী ৩টিতে ও স্বতন্ত্র ৩ জন প্রার্থী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনের পর ফলাফল প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমা তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, আমি নির্বাচনের ফল মেনে নিয়েছি। জনগণের রায়ের ওপর তো কিছুই বলার থাকে না। হারজিত থাকবেই। আঞ্জুম সুলতানা সীমার এ ধরনের বক্তব্য প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ আমাদের দেশের নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর ফলাফল প্রত্যাখ্যান করার একটা সংস্কৃতি রয়েছে। তার এই বক্তব্য আমাদেরকে সেই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসতে সহায়তা করবে। অপর দিকে বিজয়ী মেয়রপ্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু তার নির্বাচনী প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। খুব কম ভোট পড়েছে। ভয়ভীতি দেখানোর কারণে অনেকেই কেন্দ্রে আসতে পারেননি। দিনে নৌকা প্রতীকে জাল ভোট দেয়া ও সিল মারার চেষ্টা করা হয়েছে। সে যা-ই হোক, অতীতের সব ভুল সংশোধন করে আগামীতে সবাইকে নিয়ে নগর উন্নয়নের কাজ করব। কুমিল্লাকে বিশ্বমানের নগর হিসেবে গড়ে তুলবো। বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ কুসিক নির্বাচনকে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলো। সে জন্য নির্বাচনী প্রচারণায় দুই দলেরই কেন্দ্রীয় নেতাদের আমরা দৌড়ঝাঁপ করতে দেখেছি। সে চ্যালেঞ্জে বিএনপির আপাতত বিজয় হয়েছে। কোনো কোনো গণমাধ্যমে এই বিজয়কে বিএনপির নীরব ভোটবিপ্লব বলে অভিহিত করেছে। বিএনপির দাবি, মনিরুল হক সাক্কু আরো অনেক বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হতে পারতেন, যদি না সরকারি দলের লোকেরা কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট দেয়ার চেষ্টা না চালাত এবং ভোটের সময় ও ভোটের আগে তাদের কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা না হতো। কুসিক নির্বাচনে সরকারবিরোধী প্রার্থীর বিজয়ের ফলে সরকারি দলের লোকেরা বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলেই সরকারবিরোধী প্রার্থী জয় পেয়েছেন। কিন্তু এর পরও প্রশ্ন থেকে যায়।

ভোটের পরদিন জাতীয় গণমাধ্যমে নির্বাচনী অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এমনটি কিছুতেই দাবি করা যায় না যে, ভোট শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে, কিংবা নির্বাচন কমিশন শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছে। তাছাড়া প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তব্য থেকেও এটুকু স্পষ্ট, নির্বাচন পুরোপুরি সুষ্ঠু রাখা কমিশনের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি বলেছেন ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র মাঝেও নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।এর পরও কুসিক নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের একটি সক্রিয় প্রয়াস ছিলো এই নির্বাচনকে যথাসম্ভব অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করে তোলা। এর পরও প্রধান নির্বাচন কমিশনের উল্লিখিত ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা’র মাঝে গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জেনেছি অনেক কিছু ঘটে যেতে। ‘কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে যাকে বলা হচ্ছে, তার আড়ালে কুসিক নির্বাচনে যা ঘটেছে আর মাঝে আছে : প্রতিপক্ষের এজেন্ট ও কাউন্সিলর প্রার্থীকে মারধর করা, কেন্দ্র দখল, কর্মী-সমর্থকদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া, জাল ভোট দেয়া, ব্যালট পেপার ছিনিয়ে নিয়ে ইচ্ছেমতো সিল মারা, প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করা, নির্বাচনী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বাধা দেয়া, সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়াসহ আরো নানা ধরনের অনিয়ম। ফলে কুসিক নির্বাচন নিয়েও থেকে গেল নানা প্রশ্ন। এসব প্রশ্ন যাতে আর না ওঠে, সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে আগামী দিনে আরো সতর্ক হতে হবে বৈকি। আর সরকারি দলকে মনে রাখতে হবে, তাদের ঘাড়ে থাকা গণতন্ত্রহীনতার বোঝা নামানোর প্রয়াসই হবে দলের জন্য মঙ্গলকর।