সতর্কতাবস্থার পরও জঙ্গি হানার শঙ্কায় দেশের মানুষ তটস্থ 

 

র‌্যাব-পুলিশ ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক করেছে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার: চট্টগ্রামের কর্নেলহাট, মিরেরসরাই ও সর্বশেষ সীতাকুণ্ডে শক্তিশালী জঙ্গি ঘাঁটি উদঘাটনের পর স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর আশকোনা র‌্যাব ক্যাম্পে আত্মঘাতী হামলা এবং এর মাত্র ১৫ ঘণ্টার মাথায় খিলগাঁওয়ের শেখের জায়গায় র‌্যাবের তল্লাশি চৌকিতে হানা দেয়ার চেষ্টার ঘটনায় তটস্থ সারাদেশ। শুক্রবার রাতে শুধুমাত্র কারাগার ও বিমানবন্দরে সতর্কতা জারি করা হলেও শনিবার সকালে তা দেশের সর্বস্তরে বিস্তৃত করা হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশ ও আনসারসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সব বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক করেছে সরকার। জোরদার করা হয়েছে থানা, ফাঁড়ি ও ক্যাম্পের নিরাপত্তা। দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কেপিআই) অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে।

এদিকে শনিবার সকাল থেকে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের সব বিভাগ ও জেলা শহরে তল্লাশি চৌকি বাড়ানোর পাশাপাশি টহল জোরদার করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই সাথে জঙ্গি দমনে বিশেষ অভিযান পরিচালনা এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য তৎপরতা বাড়াতে র‌্যাব-পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাকে তাগিদ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। থানা, ফাঁড়ি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্পে বহিরাগতদের তল্লাশি করে ঢুকতে দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। র‌্যাব-পুলিশকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিধানের পাশাপাশি তাদের অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে দায়িত্ব পালনেরও তাগিদ রয়েছে। সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির লক্ষ্য নিয়ে এবার জঙ্গিরা মাঠে নেমেছে বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। তাই জনগণের জানমালের পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

তবে এ ধরনের সতর্কতাবস্থার পরও জঙ্গি হানার শঙ্কায় দেশের মানুষ তটস্থ হয়ে পড়েছে। জঙ্গিরা ফের কখন ভয়ঙ্কর হামলা চালায়, কোথায় ফের জঙ্গি ঘাঁটির সন্ধান মেলে- এ উদ্বিগ্নতায় জেঁকে বসেছে। পাশাপাশি জঙ্গি দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলেছে। অপরাধ বিশ্লেষকদের ভাষ্য, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতার মুখে জঙ্গিরা কিছুটা নিষ্ক্রিয় হলে তাতেই সবাই আত্মতুষ্টিতে ভুগতে শুরু করে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও এ সময় ভূয়সী প্রসংশায় মেতে ওঠেন। জঙ্গি ইস্যুতে চলে নানা ধরনের রাজনীতি। এতে জঙ্গি দমন অভিযানে আকস্মিক ভাটা পড়ে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গিরা ফের সংগঠিত হয়ে বড় ধরনের হামলা চালানোর সুযোগ করতে পেরেছে।

এদিকে জঙ্গিদের ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার ঘটনায় উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে জঙ্গিদের ঘাপটি মেরে থাকা এবং সময় সুযোগ বুঝে কিছুদিন পরপর সক্রিয় হয়ে ওঠার বিষয়টি শুধু রাজনৈতিকভাবেই নয়, অর্থনৈতিকভাবে চরম হুমকির। কেননা জঙ্গি অধ্যুষিত কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে উন্নত কোনো দেশ স্বাভাবিকভাবেই সম্পর্ক রাখতে চাইবে না। যা সামগ্রিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। দেশে সংঘটিত প্রতিটি জঙ্গি হামলার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের দায় স্বীকারের বিষয়টি ভীষণভাবে উদ্বেগজনক বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, প্রকৃত ঘটনা যাই হোক না কেন, প্রতিটি জঙ্গি হামলার পর কেন আইএসের সম্পৃক্ততার দাবি উঠছে, সরকারের তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা উচিত। ‘এটি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র’; সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জঙ্গি পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে- এ ধরনের ঢালাও বক্তব্য দিয়ে জঙ্গি ইস্যুতে সরকারের পাশ কাটানোর চেষ্টার পরিণামও ভালো নয় বলে মন্তব্য করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পর্যবেক্ষকরা। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিকদের অনেকের অভিযোগ, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর ঢাকাসহ সারাদেশের নিরাপত্তা জোরদার করা হলেও মাস না ঘুরতেই তা ঝিমিয়ে পড়ে। এমনকি ডিপোমেটিক জোন গুলশান-বারিধারার নিরাপত্তা স্তর আগের মতো ঢিলেঢালা পর্যায়ে নেমে এসেছে বলে অভিযোগ তোলেন তারা।

এদিকে জঙ্গিদের ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পাশাপাশি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর কয়েক দফা হামলা ঘটনায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেও ব্যাপক উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গিদের এবারের টার্গেট র‌্যাব-পুলিশ- এমন দাবি করে সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বক্তব্য দেয়ার পর তা আরও উসকে উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের একজন মন্ত্রী যখন প্রকাশ্যে এ ধরনের বক্তব্য দেন তখন বুঝতে হবে তার কাছে এ ব্যাপারে নির্ভরযোগ্য তথ্য রয়েছে। এছাড়াও এ ধরনের বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনাও ঘটেছে। তাই তারা মনোবল না হারালেও স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তবে সরকারের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী প্রকাশ্যে এ ধররের বক্তব্য না দিলেই ভালো হতো বলে মন্তব্য করেন ওই পুলিশ কর্মকর্তা। গতকাল সকালে রাজধানীর বেশ কয়েকটি থানা, ফাঁড়ি ও ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে পুলিশ সদস্যরা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে থানার গেটে পাহারা বসিয়েছে। রামপুরাস্থ বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, আগারগাঁও বেতার ভবন, কমলাপুর রেলওয়েস্টেশন, সচিবালয় এলাকা, কূটনৈতিক এলাকা, সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ অফিস, বিদ্যুতকেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বাস, লঞ্চ টার্মিনাল ও ভিআইপি এলাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় একই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে আমাদের প্রতিনিধিরা নিশ্চিত করেছেন।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিসিটিসি) ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের এখন আগের মতো শক্তিশালী নেটওয়ার্ক নেই। তাই তারা এখন ছোটখাটো হামলার মিশন থেকেই বড় ফয়দা নিতে চায়। আর এ কারণেই সরকারি কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, বিদেশি বিনিয়োগকারী কিংবা র‌্যাব-পুলিশ জঙ্গিদের টার্গেট হতে পারে। কেননা এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটলে স্বাভাবিকভাবেই তা আন্তর্জাতিক মহলে তোলপাড় সৃষ্টি করবে।

সিসিটিসির অপর এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সক্রিয় জঙ্গিদের সবাই সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। সম্প্রতি সময়ে গ্রেফতারকৃত জঙ্গিদের স্বীকারোক্তি, সীতাকুণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযান এবং বেশ কয়েকটি হামলার ঘটনা পর্যালোচনা করে তারা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছেন বলে দাবি করেন ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার সকাল থেকে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হলেও ধাপে ধাপে তা আরো বাড়ানো হবে। বিশেষ করে স্বাধীনতা দিবসের আগে ও পরে গোটা দেশ নিরাপত্তা জালে ঘিরে রাখতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ওই সূত্রটি জানায়, সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও স্বাধীনতা দিবসের বিভিন্ন আয়োজনে জঙ্গিরা হামলা চালাতে পারে এ আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ দিবসটির আগে-পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক রাখা হবে।