স্টাফ রিপোর্টার: চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি বাড়িতে তিন পরিবারকে জিম্মি করে রেখেছে জঙ্গিরা। গতকাল বুধবার বিকাল থেকে রাত সোয়া ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই বাড়িতে জিম্মি ছিলেন তারা। তখন সেখানে পুলিশ, র্যাব ও সোয়াত টিমের সাথে জঙ্গিদের গোলাগুলি চলছিলো। এতে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। দুপুরের পর জিম্মি পরিবারগুলোকে উদ্ধার ও জঙ্গিদের গ্রেফতারে নামে পুলিশ, র্যাব ও সোয়াতের একাধিক টিম। অভিযান চালাতে গেলে জঙ্গিরা তিন পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পুলিশকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে তিনটি গ্রেনেড। এতে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেল হক আহত হন। অভিযান সফল করতে বিকাল ৫টায় ঢাকা থেকে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের এডিসি সানোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি টিম সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে রওনা করে। এর আগে একই এলাকায় আরেকটি আস্তানায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ এক দম্পতিকে আটক করে। সেখান থেকে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, বুধবার দুপুরে সীতাকুণ্ড পৌরসভার লামারবাজার পশ্চিম আমিরাবাদে সাধন চন্দ্র ধরের মালিকানাধীন সাধন কুঠিরের নিচ তলায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় সেখান থেকে ২ মাসের শিশুসহ এক জঙ্গি দম্পতিকে আটক করে পুলিশ। পরে আটক দম্পতির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পৌরসভার চৌধুরীপাড়ার প্রেমতলায় ছায়ানীড় নামে ওই জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় পুলিশ। এ সময় ওই বাসায় থাকা জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে তিনটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে সীতাকুণ্ড থানার ওসি (তদন্ত) মোজাম্মেল হক আহত হন। পরে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। এরপর জঙ্গিদের ভয়ে পিছু হটে পুলিশ। তবে বাড়িটির চারপাশ ঘিরে রাখে। বারবার হ্যান্ডমাইকে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের জন্য আহ্বান জানায় তারা। কিন্তু পুলিশের কথায় সাড়া দেয়নি জঙ্গিরা। পরে র্যাব ও সিএমপির সোয়াত টিমকে খবর দেয়া হয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে বাড়তি পুলিশ, সোয়াত টিম ও র্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। ওই বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ আগে থেকে আইনশৃংখলা বাহিনী বিচ্ছিন্ন করে দেয়। জঙ্গি আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত ছায়ানীড় নামে ওই ভবনের মালিক নাছির উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি।
জঙ্গিদের কাছে জিম্মি তিন পরিবার: পুলিশ ‘ছায়ানীড়’ ভবনে অভিযানের প্রস্তুতি নিলে অবস্থানকারী জঙ্গিরা ওই বাড়ির তিনটি ভাড়াটিয়া পরিবারকে জিম্মি করে রাখে। পুলিশ তাদের ওপর আক্রমণ করার চেষ্টা করলে ওই তিন পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। রাত সোয়া ৯টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ ওই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে পারেনি। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ওই বাড়ি থেকে জঙ্গিরা আরও একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তবে ওই গ্রেনেডটি খালি জায়গায় বিস্ফোরিত হয়। এতে কেউ হতাহত হননি।
থমথমে পরিস্থিতি: রাতে অভিযানের সময় ছায়ানীড় ভবনের আশপাশের পুরো এলাকায় থমথমে পরিস্থিতি ছিল। জঙ্গি আস্তানার ভেতরে আটকেপড়া নারী ও শিশুদের স্বজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। এছাড়া চারদিকে হাজার হাজার উৎসুক জনতাও ভিড় করেন। পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুল ইসলাম, জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনাসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
ছাড়ানীড় ভবনের স্থানীয় বাসিন্দা হরিপদ দেবনাথ নামের এক স্কুল শিক্ষক যুগান্তরকে জানান, ‘ছাড়ানীড়’ ভবনে প্রায় সময় অপরিচিত লোকজন আসা-যাওয়া করত। স্থানীয়রা মনে করতেন তারা ওই ভবনের ভাড়াটিয়া। ওই ভবনে গত বছর হাফিজিয়া নুরানিয়া নামের একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সেটি বন্ধ করে দেয়।’
যেভাবে আটক হল জঙ্গি দম্পতি : পুলিশ জানায়, ৫ মার্চ জঙ্গি দম্পতি জসিম ও আরজিনা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে সীতাকুণ্ডের সাধন কুঠিরে বাসা ভাড়া নেয়। বাড়ির মালিক তাদের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি চাইলে তারা দেয়। পরিচয়পত্রটি নিয়ে মালিকের সন্দেহ হলে তিনি একটি কম্পিউটার দোকানে গিয়ে সেটি চেক করান। এতে দেখা যায় সেটি ভুয়া। তিনি বুধবার সকালে বিষয়টি সীতাকুণ্ড থানা পুলিশকে অবহিত করেন। এরপর বেলা ৩টার দিকে পুলিশ সাধন কুঠিরে অভিযান চালিয়ে দুই মাসের শিশুসহ জসিম ও তার স্ত্রীকে আটক করে। ওই বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড। জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা যুগান্তরকে বলেন, ‘ছায়ানীড়ের ওই বাড়িতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা-বারুদ মজুদ আছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি।’
সুইসাইডের প্রস্তুতি নিয়েছিলো আটক নারী জঙ্গি: সীতাকুণ্ড থানার ওসি ইফতেখার হাসান বলেন, সাধন কুঠির থেকে আটক আরজিনা ধরা পড়ার আগে আত্মহত্যার প্রস্তুতি নিয়েছিল। কোমরে হাত বোমা লাগানো সুইসাইড বেল্ট বেঁধে নিয়েছিল ওই নারী জঙ্গি। তবে সে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেননি। এর আগেই পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। সন্ধ্যা ৭টায় শিশুসহ ওই দম্পতিকে আস্তানা থেকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।