বিএনপিকে ধরেই নির্বাচনের প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের

জোটবদ্ধ হতে চাইছে ছোট দলগুলোও নতুন জোট গঠনে এরশাদের তোড়জোড় : তৃণমূলে কোন্দল মেটাতে এমপিদের নির্দেশ

স্টাফ রিপোর্টার: নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচন নয়’, ‘নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন দিতে হবে’ কিংবা ‘প্রয়োজনে কেয়ামতের আগ পর্যন্ত শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাব না’- বিএনপি নেতারা এরকম নানা কথা বললেও এগুলো পুরোপুরি বিশ্বাস করছেন না ক্ষমতাসীনেরা। আওয়ামী লীগের ধারণা, মুখে এখন যাই বলুক না কেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো বিএনপি আগামী নির্বাচন বর্জন করবে না। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, দলটির নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকদের বেশিরভাগেরও অভিন্ন বিশ্বাস। ১৪ দল ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা নিবন্ধিত দলগুলোও মনে করে, আর যাই হোক, যে কাঠামোয়-ই হোক না কেন-বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। বিএনপি একাদশ সংসদ নির্বাচনে আসছে, এমনটা ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ, ১৪ দল, জাতীয় পার্টি (জাপা) এবং ২০ দলের বাইরের উল্লেখযোগ্য দলগুলো আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে-ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে এমনটা মনে করছে সেটির ইঙ্গিত মেলে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কণ্ঠেও। তিনি বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচনে না এলে বিএনপির নিবন্ধন ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আমার তো মনে হয় না তারা (বিএনপি) এই ঝুঁকি নেবে। আমার মনে হয়, এখন যাই বলুক না কেন, শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনে আসবে।’ ওবায়দুল কাদেরসহ আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের কারও কারও এ ধরনের মন্তব্যের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা তো কখনও বলিনি যে, আমরা নির্বাচন করতে চাই না। বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল। আমাদের দাবিটা কি? আমাদের দাবিটা হল-নির্বাচনটা সবার অংশগ্রহণে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে। সেজন্য নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সরকার নির্বাচন দিক, সুষ্ঠু ভোটের ফল আমরা মেনে নেব, এখানে তো আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’

আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচন যে পাঁচ জানুয়ারির ধাঁচের হবে না, সেটি ইতোমধ্যে পরিষ্কার করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। গতবছর অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন ‘আগামীতে আমরা ভালো নির্বাচন দেখতে চাই। সেজন্য এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। গ্রামে-গ্রামে, পাড়া-মহল্লায় গিয়ে সরকারের উন্নয়ন তুলে ধরতে হবে।’ আগামীতে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের কথা মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকে তৃণমূলে দলীয় কোন্দল মেটানোর জন্য দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। যেসব সংসদ সদস্য ইতোমধ্যে নানা বিতর্কিত কার্যকলাপে জড়িয়েছেন তাদের শুধরানোর পরামর্শ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সবার আমলনামা আমার কাছে রয়েছে, জনগণের সঙ্গে ভালো আচরণ করুন। জনপ্রিয়তার ভিত্তিতেই আগামীতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে।’ আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক বাস্তবতা, দল ও নেতৃত্বের রাজনৈতিক ভবিষ্যত্ এবং দেশি-আন্তর্জাতিক উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে, এটা ধরে নিয়েই প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলে বিভক্তি এড়াতে ছোটখাটো অপরাধে তৃণমূলের কাউকে দল থেকে বহিষ্কার না করা এবং কমিটি বিলুপ্ত না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এ সংক্রান্ত চিঠি ইতোমধ্যে সকল সাংগঠনিক জেলা, মহানগর ও উপজেলা পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা না করার বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে যেতে হলে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত করতে হলে এখন থেকেই সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা দরকার। তিনি বলেন, বিএনপি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চায়। সরকারের উচিত নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনায় বসা। তা না হলে তো বিএনপির সামনে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প থাকবে না।

জাতীয় ঐক্যজোট নিয়ে আসছেন এরশাদ: বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসছে, এরকম ধরে নিয়ে এগোচ্ছে এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও (জাপা)। বিএনপি নির্বাচনে এলে আগামীতে রাজনীতি ও সংসদে নিজেদের অবস্থান নিয়েও নানামুখী ভাবনায় পড়েছে দলটি। তবে যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের রাজনৈতিক মূল্য বাড়াতে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের তোড়জোড় শুরু করেছে দলটি। জোট গঠনের লক্ষ্যে জাপা চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদ গত বুধবার বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এর আগে আরও দুটি নিবন্ধিত ইসলামী দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এরশাদ। আগেরদিন মঙ্গলবার এরশাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ১৫টি দল। এগুলো হলো- বাংলাদেশ  লেবার পার্টি, আমজনতা পার্টি, গণতান্ত্রিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ইসলামী ডেমোক্রেটিক পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ইউনাইটেড মুসলিম লীগ, গণ-অধিকার পার্টি, তফসিল ফেডারেশন, জাতীয় হিন্দু লীগ, সচেতন হিন্দু পার্টি, বাংলাদেশ পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (বিপিডিপি) ও ইসলামী গণ-আন্দোলন।

জাপা মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ইত্তেফাককে বলেন, ‘এ মাসেই নতুন জোটের ঘোষণা দেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি জোটের বেশিরভাগ শরিক যেন নিবন্ধিত দল হয়, অযথা অনিবন্ধিত ছোট ছোট দল নিয়ে  জোট করলে এনিয়ে কথা উঠতে পারে।’ জাপার সম্ভাব্য এই জোটের সমন্বয়ক ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায় ইত্তেফাককে জানান, সম্ভাব্য এই জোটের নাম হবে ‘জাতীয় ঐক্যজোট’। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলু এমপি বলেন, এ মাসের শেষদিকে এরশাদের নেতৃত্বে নতুন জোট হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী, উদার গণতান্ত্রিক, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী, সামাজিক রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে এ জোট হবে।

প্রসঙ্গত, গত ১ জানুয়ারি দলের ৩১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত মহাসমাবেশে এরশাদ দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমাদের মনে সন্দেহ থাকতে পারে-আগামী নির্বাচন আমরা কীভাবে করব। আমি আজ সেই সন্দেহ দূর করছি, জাপার যে শক্তি দেখছি-আমরা এককভাবেই নির্বাচন করব, অন্য কারও সাথে আর হাত মেলানোর দরকার নেই।’ এই বক্তব্যের দুই মাসের মধ্যেই জোটবদ্ধ নির্বাচনের উদ্যোগ নিলেন এরশাদ। ছোট দলগুলোও অংক কষছে: বিএনপি নির্বাচনে আসবে, এমনটা ধরে নিয়ে ১৪ দল ও ২০ দলের বাইরে থাকা নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত হলেও উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দল নানা হিসাব-নিকাশ কষছে। দলগুলোর কেউ-ই আর একা থাকতে চাচ্ছে না। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে সবাই জোটবদ্ধ হতে চাচ্ছে। কেউ নতুন জোট বাঁধার চেষ্টায় আছেন, কারও লক্ষ্য পুরনো কোনো জোটে ভিড়তে পারা। এক্ষেত্রে সবার লক্ষ্য প্রায় অভিন্ন, তা হলো আগামী সংসদে ঠাঁই পাওয়া। সংসদে যেতে না পারলেও অন্তত ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে থাকতে চায় এসব দল।

আ.স.ম রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, ওয়ার্কার্স পার্টির একাংশ, গণফোরাম, বাসদ ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যসহ সমমনা কয়েকটি দল নিজেরা জোটবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন। দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের উপস্থিতিতে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাসদের খালেকুজ্জামান বলেছেন, আমাদেরকে একমঞ্চে আসতে হবে। রব বলেন, এখন আর একা থাকার সুযোগ নেই। কাদের সিদ্দিকীর মতে, সবার এখন এক হওয়ার সময় এসেছে।

এদিকে বিকল্পধারা প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীও নতুন একটি জোট দাঁড় করানোর লক্ষ্যে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি আ.স.ম রব, কাদের সিদ্দিকী ও মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সমমনা কয়েকজনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করেছেন বলে দলটির নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।