উপচেপড়া ভিড়ের ট্রেনে স্ত্রীকে ঠেসে তুলে দিলেও উঠতে না পারা স্বামীসহ বহু মানুষের ক্ষোভ

চুয়াডাঙ্গায় টানা ৭ দিন ॥ খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের আজ দ্বিতীয় দিন ॥ বেড়েছে ভোগান্তি

 

মাথাভাঙ্গা ডেস্ক: রাত তখন ১১টা বেজে ১৮ মিনিট। বাংলাদেশ রেলওয়ের চুয়াডাঙ্গা স্টেশনের প্লাটফরমে প্রবেশ করে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস। ট্রেনে পূর্ব থেকেই উপচেপড়া ভিড়। ১৭ মিনিট পর ট্রেনটি চুয়াডাঙ্গা স্টেশন ত্যাগ করে। অতো সময়ে ট্রেনে উঠতে না পেরে শতাধিক যাত্রী  ক্ষোভের আগুনে ফুঁসে ওঠে। কেউ তার স্ত্রীকে ট্রেনে তুলতে পারলেও উঠতে পারেননি নিজে। কেউ স্ত্রী রেখেই ট্রেনে উঠে স্ত্রীকে টেনে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ দশা দেখে চুয়াডাঙ্গা স্টেশন মাস্টার ক্ষুব্ধ যাত্রীদের আশ্বস্ত করে বলেন, ওই টিকিটেই অন্য ট্রেনে ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এ কথা শুনে ক্ষুব্ধ নারী-পুরুষ ওঠেন সৈয়দপুরগামী সীমান্ত এক্সপ্রেসে। ঢাকার যাত্রীরা সৈয়দপুরগামী ট্রেনে কেন? এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে স্টেশন মাস্টার বলেন, কেউ নামবেন নাটোরে, কেউ নামবেন ঈশ্বরদী। সেখান থেকে ঢাকাগামী ট্রেনে উঠবেন এরা।

শুধু চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে নয়, আলমডাঙ্গা, পোড়াদহ স্টেশনেও প্রায় অভিন্ন চিত্র এখন দিনে ও রাতের ঢাকাগামী ট্রেনের। কারণ খুলনা বিভাগের ১০টি জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট। গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে এ পরিবহন ধর্মঘট শুরু হয়েছে। এর আগে গত ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে থেকে চুয়াডাঙ্গা জেলায় অব্যাহত ছিলো পরিবহন ধর্মঘট। এ কারণে যাত্রী সাধারণকে অবর্ণনীয় জনদুর্ভোগ পোয়াতে হয়। গতকাল সেই দুর্ভোগ বেড়েছে বহুগুণ। তাছাড়া চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রধান প্রধান সড়কের প্রবেশদ্বারে পরিবহন শ্রমিকদের অনেকেই অবস্থান নিয়ে পিকেটিং করে। তারা মাইক্রোবাস দেখলেও রুখে দাঁড়ায়। শ্যালোইঞ্জিনচালিত করিমন নসিমন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ব্যাটারিচালিত অটোর যাত্রীদের যেমন হয়রানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে, তেমনই তিন চাকার মাহেন্দ্র যাত্রীদেরও পড়তে হয়েছে বিপাকে। পক্ষান্তরে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চৌধুরী বলেছেন, চলমান পরিবহন ধর্মঘট অযৌক্তিক। এতে কোনো লাভ হবে না। ফলে ধর্মঘট থেকে সরে দাঁড়িয়ে উচ্চ আদালতে আইনের পথে হাঁটাই ভালো।

আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ ৫ জন নিহতের মামলায় বাসচালক জমিরকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়ার প্রতিবাদে আলমডাঙ্গা মাইক্রো-কার শ্রমিক ইউনিয়ন বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। গতকাল রোববার সকাল ১১টায় মাইক্রো-কার স্ট্যান্ড থেকে র‌্যালি বের করে চারতলার মোড় দিয়ে বাস টার্মিনাল হয়ে মাইক্রোস্ট্যান্ডে শেষ করে। পরে এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন মাইক্রো-কার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি রফিকুল ইসলাম রঞ্জু, সম্পাদক রানা আহমেদ, সহসভাপতি সোহেল রানা, সহসম্পাদক মিরাজ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন সড়ক সম্পাদক মিলন, তরিকুল ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ রাসেল, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, দেলোয়ার, মাসুদ রানা, মিজানুর রহমান মন্টু, রেজাউল হক মন্টু, সেন্টু, মানিক, আশিক, সোহেল , রাজু আহমেদ, হাকিম, কাজল, ফারুক, তুষার প্রমুখ। এ সময় বক্তরা বলেন, বাসচালক (চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্স) জমির হোসেনের মামলায় ৩০৪/খ ধারায় মামলা হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে বিচার হয়েছে ৩০৪/ক ধারায়। তার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ার পরও বিচারক তাকে শাস্তি দিয়েছেন। তারা বলেন, আমরা যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবো না। অবিলম্বে এ যাবজ্জীবন রায় বাতিল না করলে আমরা কঠোর আন্দোলন করবো। প্রয়োজন হলে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ খুলনা বিভাগের ১০ জেলা না সারা বাংলাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট করা হবে।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, গতকাল রোবাবর ভোর থেকে শুধু দূরপাল্লার পরিবহনই কেবল নয় অভ্যন্তরীণ রুটেও সকল প্রকার যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা। মোটরশ্রমিকরা ভ্যান, রিকশা, ইজিবাইক, সিএনজিসহ আলমসাধু ও করিমন-নসিমন পর্যন্ত চলতে দিচ্ছেন না। এতে সাধারণ যাত্রীসহ চলতি এসএসসি পরীক্ষার্থীরা চরম বিপাকে পড়েছেন। তারা বিভিন্নভাবে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। গত বুধবার থেকে এ পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়।

২০১১ সালের ১৩ আগস্ট ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জের জোঁকা এলাকায় ঢাকাগামী চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে মাইক্রোবাসে থাকা চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হন। এ দুর্ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করে। মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবীর গত বুধবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে বাসচালক চুয়াডাঙ্গার জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত করা হয়।

রায় ঘোষণার প্রতিবাদে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের আঞ্চলিক শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনের ডাকে চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ জীবননগরে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ রুটের সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। গত শনিবার যশোরের চাঁচড়া এলাকায় শ্রমিকদের আঞ্চলিক কমিটির অফিস শ্রমিক ভবনে ডাকা জরুরি সভার খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন আঞ্চলিক কমিটি। সভায় রোববার ভোর ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় এই ধর্মঘট পালিত হচ্ছে।

জীবননগর উপজেলা বাস-ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজা বলেন, শ্রমিকরা যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় মাথায় নিয়ে গাড়ি চালাবে না শ্রমিকরা। জীবননগর উপজেলার অভ্যন্তরে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। রায় পরিবর্তন না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।