সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়ের ঘুঁটি সাজাচ্ছে শাসকদল

 

স্টাফ রিপোর্টার: সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনে জিতে ২০১৯ সালে আবারও ক্ষমতায় আসতে চায় শাসকদল আওয়ামী লীগ। আর সেভাবেই ঘুঁটি সাজাচ্ছে তারা। এজন্যই পরিকল্পিতভাবে তারা নির্বাচন কমিশন গঠনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে সব দলের অংশগ্রহণ এবং সার্চ কমিটিতে নির্বাচন কমিশনারদের তালিকা জমা দেয়া পর্যন্ত বিতর্কমুক্ত থেকেছে। একইভাবে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের আগ পর্যন্ত কোনো ভুল ও বিতর্কিত পদক্ষেপের ব্যাপারে সতর্ক থাকবে তারা।

সূত্র জানায়, এর পাশাপাশি সবগুলো রাজনৈতিক দলকে বর্তমান সরকারের অধীনে ২০১৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো হবে। এছাড়া দলীয় নেতাদের বক্তব্যের মাধ্যমে বিরোধী দলগুলোকে জানান দেয়ার চেষ্টা করা হবে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে না এলে ৫ জানুয়ারির মতো ভুল করা হবে। ইতোমধ্যে মাদারীপুরে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে দল হিসেবে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে।

সূত্র জানায়, তিস্তাচুক্তি না হওয়া এবং চীন থেকে সাবমেরিন কেনার কারণে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। সেজন্য আগামী নির্বাচনে দেশটির নিরঙ্কুশ সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান ক্ষমতাসীনরা। সেজন্য ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন করে সামাল দেয়া যাবে কি-না, তা নিশ্চিত নয় শাসকদল। তাই ক্ষমতায় থেকে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য যথেষ্ট সাবধানতা ও কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সরকার যেমন কঠোর ছিল, এবার কৌশলগত কারণে নমনীয় ভাব দেখাচ্ছে দলটি। বাগেরহাটে এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তারা সার্চ কমিটির কাছে যাদের নাম প্রস্তাব করেছেন, সেখান থেকে সব বাদ দিলেও তারা কোনো প্রতিবাদ করবেন না। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে রাষ্ট্রপতি যাদের নিয়োগ দেবেন, আওয়ামী লীগ তাদেরই মেনে নেবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কখনো কঠোর, আবার কখনো নরম হয় রাজনৈতিক কৌশল। যেমন, বিএনপির দলীয় ও নেতাদের সংবাদ সম্মেলন, জিয়ার মাজারকেন্দ্রিক কর্মসূচি, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপ এবং নির্বাচন কমিশনারদের নামের তালিকা জমা দেয়া ঘটনাবলীর ব্যাপারে সরকারের মনোভাব নমনীয়। আর ৭ নভেম্বর এবং ৫ জানুয়ারির কর্মসূচি পালন করতে না দেয়ার ব্যাপারে তারা কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। এর মানে, বিএনপিকে আন্দোলনের কোনো ধরনের সুযোগ দেবে না আওয়ামী লীগ। তবে তাদের অধীনে নির্বাচনে আসতে চাইলে কোনো বাধা দেয়া হবে না। তারা বলেন, সরকারের সদিচ্ছা ছাড়া স্বাধীন ও শক্ত মেরুদ-ের নির্বাচন কমিশন গঠন এবং সুষ্ঠু নির্বাচন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করার মতো সাহসী ব্যক্তি নতুন কমিশনে আসবে কি-না, তাও চিন্তার বিষয়।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা সরকারের থাকত, তাহলে আগেই নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করত। সরকারের যদি সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটি আইওয়াশ ছাড়া আর কিছুই হবে না। বিএনপিকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে নিয়ে আসতে শুধু কৌশল হিসেবে কাজ করবে। কারণ, নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকারের ইচ্ছার বাইরে রাষ্ট্রপতির কিছু করার ক্ষমতা নেই। তিনি বলেন, সরকারের আমলারা সাধারণত সরকারের মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করেন না। তারা স্বাধীন হতেও পারেন না। তাই আওয়ামী লীগ কতটুকু শক্ত মেরুদণ্ডের নির্বাচন কমিশন গঠন করবে এবং তারা কতটুকু কাজ করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ বলেছেন, নতুন কমিশনও তাদের মতোই হবে। এর মানে বোঝাই যাচ্ছে, কমিশন কী হবে। আর রকিব কমিশনকে যিনি বাছাই করেছেন, এবারও তিনিই সার্চ কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই নতুন কমিশন আওয়ামী লীগের নির্দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করবে বলে মনে হয় না।

শাসকদলের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার মতে, রাজনীতি এক ধরনের খেলা। যার খেলার কৌশল ভালো হবে, তিনিই জয়লাভ করবেন। বিএনপি গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আওয়ামী লীগ এ ধরনের কোনো হামলা করেনি। তারা কৌশলে বিএনপিকে দুর্বল করেছেন। তাদের সামর্থ্য থাকলে এবং কৌশল ভালো হলে তারা জয়লাভ করবেন। তবে বিএনপির কৌশলে কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে আওয়ামী লীগ। কারণ, বিএনপি একদিকে সরকারের সমালোচনা করছে, পাশাপাশি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছে। সার্চ কমিটিকে আওয়ামী লীগের লোক বলে কড়া সমালোচনা করেছে, আবার তাদের প্রস্তাবে নির্বাচন কমিশনারদের নামের তালিকা জমা দিয়েছে। বিএনপির এই কৌশলের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যায়যায়দিনকে বলেন, এসব বিএনপির কৌশল নয়; অজ্ঞতা। তারা সংবিধান পড়েনি, তাই রাষ্ট্রপতির কাজের সমালোচনা করে। দলের চেয়ারপারসনের কাছে তো জ্ঞানীরা ভিড়তে পারে না; অজ্ঞরা চারপাশে ঘুরছে। তাই দলের এই অবস্থা।’ তিনি বলেন, মওদুদ সাহেবরা বোঝেন, কিন্তু তাদের দাম নেই। শেষ পর্যন্ত মওদুদ সাহেবের কথামতো বিএনপি সংবিধান অনুযায়ী এগোচ্ছে। সংবিধানের বাইরে গিয়ে বুঝেছে, কোনো লাভ হয়নি। তাই এবার আর আগের ভুল করতে চাইছে না বিএনপি।’ আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, আগামী নির্বাচনে ফের জয়লাভের ব্যাপারে তারা আত্মবিশ্বাসী। নেতাদের ভাষ্য, দেশের মানুষ তাদের উন্নয়নে সন্তুষ্ট। কিন্তু এরপরও ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তনের সময়টুকুতে যাতে কোনো অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য একটি নির্বাচিত সরকার থাকা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, রাষ্ট্রপতি নিজস্ব সাংবিধানিক ক্ষমতা অনুযায়ী দেশের খ্যাতিমান লোকদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি সার্চ কমিটি গঠন করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, বিএনপি এটা তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু পরে ভুল বুঝতে পেরে কমিটিতে নাম দিয়েছে। অন্যদিকে, বিএনপির সমালোচনা করে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেন, ভুল রাজনীতি, ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জনগণের কাছ থেকে বিএনপি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। জনগণের রায় মেনে নেয়ার মানসিকতা তাদের নেই। এখন কোনো ইস্যু না থাকায় ইসিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে। নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে লাভবান হওয়া যাবে না। তিনি বলেন, তারা রাষ্ট্রপতির ওপর আস্থা রাখেন; এবং বিএনপিরও উচিত, বির্তক সৃষ্টি না করে আস্থা রাখা। সার্চ কমিটির কাছে সব দল স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করেছে। তারা আশা করেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের মতে, গত জাতীয় নির্বাচন একতরফা হয়েছে বিএনপির দোষের কারণে। তাদের কারণে শেখ হাসিনা সমালোচিত হয়েছেন। তাই এবার দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি সুন্দর নির্বাচন করতে চায় আওয়ামী লীগ, যা বিএনপিসহ সবাই মেনে নেবে। তবে নির্বাচনের সময় কোনো অশুভ শক্তিকে ক্ষমতার অপব্যবহার করার সুযোগ দেয়া হবে না। শাসকদলের নেতারা মনে করেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি যদি স্বেচ্ছায় অংশ নেয় এবং পরাজিত হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বড় আন্দোলন করার নৈতিক অধিকার থাকবে না। এই সময়ে রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় দক্ষ হয়ে উঠবেন প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। এছাড়া আন্দোলনবিহীন এই সময়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখে জনগণকে খুশি করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকবে তারা।