সেনাবাহিনী অশুভ শক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে প্রস্তুত : প্রধানমন্ত্রী

 

স্টাফ রিপোর্টার: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়ে ওঠা সেনাবাহিনী যে কোনো অশুভ শক্তিকে দৃঢ়ভাবে প্রতিহত করতে পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত। সাঁজোয়া, গোলন্দাজ ও পদাতিক বাহিনীর নতুন প্রবর্তিত যুদ্ধ সরঞ্জামে সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা আরো সুদৃঢ় হয়েছে। গতকাল শনিবার সকালে নোয়াখালীর স্বর্ণদ্বীপে (জাহাইজ্জার চর) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ম্যানুভার অনুশীলন-২০১৬ মহড়া অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, আমাদের চৌকস সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক রণসজ্জা ও তাদের সুদৃঢ় কার্যক্রম পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর বহন করে। সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে নতুন সংযোজিত ট্যাংক এমবিটি-২০০০, এপিসি বিটিআর-৮০, সেল্ফ প্রোপেলড আর্টিলারি গান, নোরা-বি-৫২, রাডার বিহেকেল এসএলসি-২, ট্যাংক বিধ্বংসী মিসাইল এমইটিআইএস-এম-১ সমরাস্ত্রের ব্যবহার, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য সকল কোরের পেশাদারিত্ব দেখে আমি সেনাবাহিনীর সার্বিক সক্ষমতায় সম্পূর্ণ আশ্বস্ত।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই মহড়া সেনাবাহিনীর দক্ষতা ও পেশাদারিত্বেরই প্রতিফলন, যা একটি আধুনিক ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উত্কৃষ্ট উদাহরণ। ১১ পদাতিক ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে এবং ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আশরাফ মহড়াটি পরিচালনা করেন। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহম্মদ শফিউল হক অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, নৌ ও বিমানবাহিনী প্রধানগণ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, জিওসি ১১ এবং ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার, নন কমিশন্ড অফিসার ও সৈনিকবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর মহড়া অবলোকন এবং বিভিন্ন উন্নয়নকাজের উদ্বোধন করতে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার মেঘনা নদীতে জেগে ওঠা চর জাহাইজ্জার চর সফর করেন। চরটির নতুন নামকরণ করা হয় স্বর্ণদ্বীপ। দুপুরে হেলিকপ্টারে করে প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণদ্বীপ পৌঁছে মাল্টি পারপাস সাইক্লোন শেল্টারের উদ্বোধন করেন এবং সেখানে একটি নারকেল গাছের চারা রোপণ করেন। অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর কোয়াটার মাস্টার জেনারেল লে. জেনারেল আনোয়ার হোসেন দ্বীপটি গড়ে তোলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ড নিয়ে একটি ভিডিও প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিফ করেন। নোয়াখালীর দক্ষিণে ১৯৭৮ সালে মেঘনা নদীতে জেগে ওঠে এই চর। ৩৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই চরটি ২০১৩ সালে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং বসতি স্থাপনের উপযোগী করে তুলতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাগর পৃষ্ট থেকে এর উচ্চতা ৩ মিটার। নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত এই দ্বীপটি দীর্ঘকাল ধরে দুষ্কৃতকারীদের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহূত হয়ে আসছিল এবং তাদের কার্যক্রমে এই অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসনের স্বাভাবিক প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছিল। সেনাবাহিনী দ্বীপটির দায়িত্ব গ্রহণের তিন বছরে এর অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে। ইতিমধ্যেই এখানে দুটি সাইক্লোন শেল্টার এবং একটি কন্টেইনার বেইজ্ড ক্যাম্প তৈরি হয়েছে। স্বর্ণদ্বীপ-এর প্রশিক্ষণ এলাকার সুপরিকল্পিত ব্যবহার দেখে এবং এলাকাটির সার্বিক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমি বিশেষ ধন্যবাদ জানাই সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশন ও কুমিল্লা এরিয়ার সকল অফিসার, জেসিও এবং অন্যান্য পদবির সৈনিকদের যারা তাদের পরিবার পরিজন ছেড়ে এই নির্জন দ্বীপের বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশে অবস্থান করছেন, রাত দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে এই দ্বীপটিকে সত্যিই একটি স্বর্ণদ্বীপ-এ পরিণত করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ একটি সুদক্ষ, সুশৃঙ্খল ও সুসংগঠিত বাহিনীরূপে সমগ্র বিশ্বে সুপ্রতিষ্ঠিত।  এই দ্বীপে আরো তিনটি সাইক্লোন শেল্টার অতিদ্রুত তৈরির পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশনা অনুযায়ী এই দ্বীপে বসবাসকারীদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কার্যক্রম ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এত অল্প সময়ে এত বিপুল কার্যক্রম সত্যিই ভূয়সী প্রশংসার দাবিদার। এ জন্য আমি সেনাবাহিনীসহ কৃষি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, মত্স ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে জানাই অভিনন্দন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন যে, এই দ্বীপটি মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত হওয়ায় এটি অত্যন্ত ক্ষয়প্রবণ। এটিকে বসবাসের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হলে নদী ভাঙন থেকে রক্ষা করা একান্ত আবশ্যক। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় নিয়মিত এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এজন্য আমি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও এর গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

জাতির পিতার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সর্বদাই দেশের সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকারও সময়োপযোগী একটি আধুনিক ও উন্নত সামরিক বাহিনী গঠনের লক্ষ্যে বহুবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যা সারা বিশ্বে আমাদের সামরিক বাহিনীকে একটি উন্নত ও আধুনিক বাহিনীর মর্যাদা এনে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা জানেন যে, ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় ১০ ও ১৭ পদাতিক ডিভিশন, আর্টিলারি ও পদাতিক ব্রিগেড এবং কয়েকটি আর্টিলারি, পদাতিক ও ইঞ্জিনিয়ার ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। একই সাথে লেবুখালী, মিঠামাইন এবং পদ্মা সেতু এলাকায় বৃহদাকার সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শীতকালীন প্রশিক্ষণ চলাকালে শীতবস্ত্র বিতরণ, বিনামূল্যে চিকিত্সা প্রদান তথা আপনাদের কর্তৃক গৃহীত অন্যান্য সেবামূলক কার্যক্রমের কথা জানতে পেরে আমি অত্যন্ত খুশি হয়েছি। দেশ ও জনগণের সেবায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রয়েছে সর্বজন স্বীকৃত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের বিভিন্ন দুর্যোগ দুর্বিপাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দুর্গত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সবসময়। বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা মোকাবেলাতেও জনগণ আপনাদের একান্ত সাহায্য ও অকৃত্রিম সহযোগিতা পেয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে ফ্লাইওভার নির্মাণ, পরিবেশ উন্নয়নে হাতিরঝিল প্রকল্প এবং অগ্নিকাণ্ড ও অন্যান্য দুর্যোগে উদ্ধার কার্যক্রমে সেনাবাহিনীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেশবাসীর ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে। তিনি বলেন, দীর্ঘ কক্সবাজার-টেকনাফ প্রকল্প, প্রভৃতির কাজ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নিরাপত্তা ও তদারকি, ঢাকা-মাওয়া ও জাজিরা-ভাঙ্গা সংযোগ সড়ক বর্ধিতকরণ, সীমিত আকারে নদী শাসন, পদ্মা সেতুতে প্রথম দিন হতেই ট্রেন চালু করার লক্ষ্যে ‘পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প’র সুপারভিশন পরামর্শক হিসাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণে অতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীর ডেইরি ফার্ম এবং একটি নারকেল বাগান ঘুরে দেখেন।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যাতে এসব প্রতিষ্ঠান ক্ষমতার বিকেন্দ্রীয়করণে যথেষ্ট শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে লন্ডনস্থ বেন্টের মেয়র পারভেজ আহমেদ সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে এলে এ কথা বলেন। বৈঠকে বৃটিশ হাউস অব কমন্সের সদস্য, বঙ্গবন্ধুর নাতনি এবং শেখ হাসিনার ভাগনি টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রধানমন্ত্রী বেন্টের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেয়রকে স্বাগত জানিয়ে ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের ব্রিটিশ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং তাদের অবস্থানের দেশটির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি দুই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হকের লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবাইনের শ্যাডো পার্লামেন্টের অন্তর্ভুক্তির জন্যও সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সে নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশি কন্যাদের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেখে তিনি গর্বিত।