কেঁচো ও সার উৎপাদন : ২টি ইউনিয়নে ১ হাজার নারী এখন স্বাবলম্বী

 

শিপলু জামান: কারো বাড়ির বারান্দায়, ঘরের মধ্য, কারো বা উঠানে, রান্নাঘরে, বাথরুমের পাশে সারি সারি রাখা আছে মাটির/সিমেন্টের চাড়ি। বাড়ির বাইরে রয়েছে টিনের চালা আর নিচে পাকা হাউজ। এগুলো সবই কম্পোস্ট সারের প্লান্ট। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার  নিয়ামতপুর ইউনিয়নের দাপনা গ্রাম এখন কেঁচো আর কম্পোস্ট সারের গ্রামে পরিণত হয়েছে।  আর এই গ্রামের শতভাগ বাড়িতে এখন কেঁচো ও সার উৎপাদন হচ্ছে। আর এই কাজ করছে বাড়ির নারীরা। ঘরের কাজের পাশাপাশি তারা প্রতিমাসে আয় করছে হাজার হাজার টাকা। প্রতিটি বাড়িতে রয়েছে ৫ থেকে ১০০ কেজি করে কেঁচো।  গ্রামের ৬০ ঘর পরিবার এখন আর রাসায়নিক সার ব্যবহার করে না। নিজেদের উৎপাদিত পরিবেশ বান্ধন কম্পোস্ট সার দিয়েই জমিতে চাষাবাদ করছে।  মাসে তারা ৬ লক্ষ হাজার টাকার সার ও  কেঁচো উৎপাদন করছে। সমগ্র উপজেলা থেকে প্রায় মাসে ২০ লক্ষ টাকার কেঁচো আর সার উৎপাদন হচ্ছে। ১ কেজি কেঁচো ১৫০০ টাকা আর কম্পোষ্ট সার ১০ টাকা দরে বিক্রি করছে তারা। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এখানকার কম্পোস্ট সার সৌদি আরব, দুবাইসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হচ্ছে। দাপনা গ্রামের মেয়েদের মতো উপজেলার নিয়ামতপুর ও রায়গ্রাম ইউনিয়নের হাজারো  নারী এ কাজের সাথে জড়িত হয়েছে। এই কাজে তাদের  সার্বিক সহযোগীতা করেছেন জাপান ভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ড ও উপজেলা কৃষি অফিস।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলার মোস্তবাপুর গ্রামে ৮৫ জন, মহেশ্বরদাচা গ্রামের ৯০ জন, নিয়ামতপুর গ্রামের ৬৫ জন, মহিষাডোরা গ্রামের ৪৬ জন, বলরামপুর গ্রামের ১৬১ জন, অনুপমপুর গ্রামের ৬১ জন, হরিগোবিন্দপুর গ্রামে ৫৬ জন, আড়ুয়াশলুয়া গ্রামে ৬১ জন, বলাকান্দর গ্রামের ৫১ জন, ভোলপাড়া গ্রামের ৫৩ জন, বারোপাখিযা গ্রামের ১২৬ জন, খামারমুন্দয়া গ্রামে ১৪ জন, আগমুন্দিয়া গ্রামে ২৫জন এবং মল্লিকপুর গ্রামের ৮১ জন নারীসহ সহাস্রাধিক নারী এই কেঁচো চাষ করছেন। দিনে দিনে তাদের চাষ পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামের পর গ্রাম।

কালীগঞ্জ উপজেলা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পূর্বের গ্রাম দাপনা। এই গ্রামের নারীরা খুবই কর্মট। প্রত্যেকের বাড়িতেই ২ থেকে ৮টি পর্যন্ত গরু আছে। তারা তাদের গরুর গোবর কাজে লাগিয়ে  কেঁচো আর সার তৈরি করছে। যে সার পরিবেশ বান্ধব। এই গ্রামে শতভাগ বাড়িতে কম্পোস্ট প্লান্ট বানাতে পরামর্শ সহযোগিতা দিয়ে সহযোগিতা করেছেন রেবেকা ও সোনাভান নামের দুই গৃহবধূ। তারা প্রথম পর্যায়ে হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতায় এই কাজ শুরু করেন। এর পর পুরো গ্রাম। গ্রামের ৬০টি ঘরেই এখন কেঁচো আর কম্পোস্ট উৎপাদন হচ্ছে। গৃহবধূ রেবেকার ঘরের মধ্যে, রান্নাঘরে, বারান্দায়, গোয়ালঘরে, বাড়ির পরিত্যক্ত জায়গায় কাচা, পাকা বেশ কয়েকটি কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করেছেন। প্রতি মাসে তিনি  প্রায় ৪০০ কেজি কম্পোস্ট  ও প্রায় ২০ কেজি  কেঁচো উৎপাদন করছে। এক কেজি কম্পোস্ট সার ১০ টাকা আর এক কেজি কেঁচো ১৫০০-১৮০০ টাকায় বিক্রি করছেন।  গড়ে তার মাসে আয় ১০ হাজার টাকা।  একই গ্রামের কৃষাণী আতিয়ারের স্ত্রী শাহনাজ, মশিয়ারের স্ত্রী সোনাভান, শওকতের স্ত্রী সুখজান, কুদ্দুসের স্ত্রী হাজেরা বেগম, জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আহরনসহ ৬০টি পরিবারের সকল গৃহিণীরা তাদের বাড়িতে কেউ মাটির  রিং স্লাব, কেউ বা পাকা করে কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করেছে। প্রতি মাসেই তাদের প্লান্ট থেকে সার ও কেঁচো উৎপাদন হচ্ছে। তারা উৎপাদিত কম্পোস্ট সার  নিজেদের জমিতে ব্যবহার করে বাকিটুকু বিক্রি করছে। দেশের যশোর, চুয়াডাঙ্গা, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লার ব্যবসায়ীরা এখান থেকে ট্রাক ভরে সার ও কেঁচো ক্রয় করে নিয়ে গিয়ে পরে সেগুলো প্যাকেটিং করে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, সৌদিআরবসহ বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। কেঁচো কম্পোস্ট সার বিশেষ করে ধান, পান চাষী, সবজী জাতীয় চাষাবাদে বেশি উপকার পাচ্ছে।

শুধু তাই না এই গ্রামের কৃষাণীরা সবাই মিলে একটি মহিলা সমবায় সমিতি করেছেন। সার বিক্রির একটি অংশ তারা সমবায় সমিতিতে জমা রাখেন। এই সমিতির বর্তমান মূল ধন প্রায় ৩ লাখ টাকা। তারা ইতোমধ্যে সমিতির মাধ্যমে একটি পাওয়ারট্রিলার, ২টি গরু ক্রয় করেছে। আর নগদ টাকা সমিতির সদস্যদের মধ্যে ঋণ দিয়েছেন। শুধু তাই নয় গ্রামের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের তারা লেখা পাড়ায় বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেন তারা। নারীদের বক্তব্য আমরা আর স্বামীদের কাছ থেকে হাত খরচের টাকা নিই না। বরং স্বামীদের বিভিন্ন সময় টাকা দিয়ে সহযোগিতা করি।

মোস্তবাপুর গ্রামের কৃষাণী ও ইউপি সদস্য মনোয়ারা বেগম জানান, কেঁচো কম্পোস্ট  সার উৎপাদন করতে বেশি টাকা খরচ হয় না। দরকার আগ্রহ। গরুর গোবর, লতাপাতা, কলাগাছ আর কেঁচো এই দিয়েই প্রতি তিন মাস অন্তর সার উৎপাদন করা হয়। এই সারের গুনগত মানও ভালো।  যশোর মৃত্তিকা গবেষণা কেন্দ্রে তারা এ জৈব সার পরীক্ষা করে দেখেছেন বাজারের যে সব টিএসপি পাওয়া যায় তার মান ৪৫% অন্যদিকে  কম্পোস্ট সার বা অর্গানিক সারের মান ৮৫% (সার্বিক)। তিনি আরও জানান,তার নিজের প্রায় ২০ কেজি কেঁচো আছে যার আনুমানিক মুল্য প্রায় আড়াই লাখ টাকা।

স্বেচ্ছাসেব সংস্থা হাঙ্গার ফ্রি ওয়ার্ল্ডের প্রোগ্রাম অফিসার এস এম শাহিন হোসেন জানান, দাপনা গ্রামসহ কালীগঞ্জ উপজেলার ২টি ইউনিয়নের কৃষকদের পাশাপাশি কৃষাণী/গৃহিণীদের কম্পোষ্ট তৈরি ও কেঁচো উৎপাদন বিসয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন। আর কৃষনীদের প্রশিক্ষণের জন্য দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের একমাত্র জৈবচাষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি কালীগঞ্জের রায়গ্রাম ইউনিয়নের আগমুন্দিয়ায় স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে হাতে কলমে কৃষক/কৃষাণীয়দের জৈবচাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় সেই সাথে কিছু অনুদান প্রদান করেছেন। তারা জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদ করার জন্য কৃষক/কৃষাণীদের উদ্বুদ্ধ করছে।

নিয়ামতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাজু আহমেদ রনি জানান, কেঁচো কম্পোষ্ট এলাকার কৃষিতে বিশাল এক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। পুরুষের পাশাপাশি এলাকার স্বামী পরিত্যাক্তা, বিধবা ও দরিদ্র মহিলারা কেঁচো কম্পোষ্ট উৎপাদন করে। এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এই কেঁচো চাষ হচ্ছে। এসব পিছিয়ে পড়া নারীদের সফলতা দেখে আমি মুগ্ধ। দাপনাসহ নিয়ামতপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের নারীরা যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাতে খুব শ্রীঘ্রই এই ইউনিয়ন দেশের নিরাপদ খাদ্যের মডেল ইউনিয়নে পরিণত হবে।

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার জাহিদুল করিম জানান, কম্পোস্ট সার পরিবেশ বান্ধব। উপজেলার অধিকাংশ গ্রামের কৃষাণীরা যে নিজেদের উৎপাদিত সার জমিতে ব্যবহার করছে এটা ভালো উদ্যোগ। কৃষি অফিসও তাদের সার্বিক সহযোগিতা  করছে। কেঁচো কম্পোষ্ট বা জৈব সার কৃষি চাষাবাদে দারুন ফলপ্রসু। এটা মাটিকে যেমন সুস্থ্য রাখে তেমন এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত সবজি ও ফসল খেলে সুস্থ্য জীবন উপভোগ করা যায়।

কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ছাদেকুর রহমান জানান, উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীরা বাড়ির কাজের পাশাপাশি কেঁচো ও সার উৎপাদন করছে এটা খুবই ভালো। কৃষাণীদের যদি কোনো সহযোগিতা লাগে তারা আমার সাথে যোগাযোগ করলে সার্বিক সহযোগিতা করবো।