বাংলাদেশ-ভারত ও মিয়ানমারের ভূ-গর্ভে বিশাল ফাটলের সন্ধান!

 

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে যেকোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশ, ভারত-মিয়ানমারের সংযোগ স্থলের ভূ-গর্ভে বিশাল ফাটলের সন্ধান পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে বাংলাদেশসহ এর আশপাশের এলাকায় ৮ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের গবেষণা বিষয়ক জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সে এই তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।

ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী ড. মাইকেল স্টেকলারের নেতৃত্বে একদল গবেষক ভূমিকম্পের বিষয়ে গবেষণাটি করেছে। তারা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম জানায়, এই ফল্ট লাইনটি এখনো সচল। এর আগে এমন বড় ফাটল থেকে ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে বিপর্যয় হয়। এরপর ২০১১ সালে জাপানেও একই রকম বিপর্যয় দেখা দেয়।  দু’বারই বিশাল সুনামির উৎপত্তি হয়েছিলো সেখান থেকে। এমনকি এই ফাটল থেকে যে ভূমিকম্প হবে তাতেও সুনামির আশঙ্কা রয়েছে। তবে কবে এমনটি হতে পারে এ ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয় বলে তারা জানিয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, যেকোনো সময়ই ঘটতে পারে এমন দুর্ঘটনা। তবে যখনই হোক না কেন, এটা বাংলাদেশের জন্য হয়তো বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হবে। এ জন্য সরকারকে ভূমিকম্প সহনশীল স্ট্রাকচার তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন তারা। জার্নালটিতে বলা হয়, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশে লাখ লাখ টন পলি জমেছে। তা ওই ফাটলের শেষ মাথায় এক ধরনের চাপের সৃষ্টি করছে। একটি জায়গায় দুটি গতিশীল ভূ-গাঠনিক প্লেট পরস্পরের ওপর চেপে বসতে থাকায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারতে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ জার্নালেই গত বছরের জুলাই মাসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো, বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের ভূ-গাঠনিক প্লেট উত্তর-পূর্ব দিকে সরে গিয়ে মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের ভূ-গাঠনিক পেটে চাপ সৃষ্টি করছে, এ কারণে বারবার মিয়ানমারে কম্পন হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্ব অংশের প্লেট মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলের প্লেটকে বছরে ৪৬ মিলিমিটার করে ঠেলছে। দুই প্লেটের সংযোগস্থলে ভূমিকম্পের শক্তি জমা হচ্ছে অন্তত ৪০০ বছর ধরে। ওই শক্তি একসাথে মুক্তি পেলে তা প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৬২ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা এই ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে আছে।

গতকাল মঙ্গলবার দু দফা ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশ। প্রথমটির রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৫ এবং ছিলো দ্বিতীয়টির ৫ দশমিক ১। এতে আতঙ্কিত হয়ে ২ জন মারা যায়। আহত হয় অনেকেই। বাড়িঘরে ফাটল ও মাটি ভেদ করে বালু উঠে আসার খবর পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের এই দিনে অর্থাৎ ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। এতে আতঙ্কিত হয়ে হুড়াহুড়িতে ৫ জন মারা যায়। আহত হয় শতাধিক। বিশেষজ্ঞদের মতে, গোটা ভূ-পৃষ্ঠ কয়েকটি স্তরে বিভক্ত। আবার প্রতিটি স্তর একাধিক প্লেটে বিভক্ত। এসব বিশাল আকারের টেকটোনিক প্লেটগুলো যখন একের সঙ্গে অপরে ধাক্কা খায় তখন কেঁপে ওঠে মাটির নিচের তলদেশ। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল. মিয়ানমার একই টেকটনিক প্লেটে অবস্থিত। এ কারণে প্লেটগুলোর নাড়াচাড়া করলেই এসব এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। টেকটোনিক প্লেটের অবস্থান অনুযায়ী, বাংলাদেশে উত্তর ও পূর্বে দুটো বর্ডার বা টেকনিক্যাল ভাষায় ভূ-চ্যুতি রয়েছে যা বাংলাদেশের ভূমিকম্পের কারণ। এজন্য বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল তথা সিলেট এবং এর আশপাশের এলাকা প্রবল ভূমিকম্প-প্রবণ। এরপর ঢাকা ও রাজশাহী শহরও ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকা।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের আশপাশে অনেকগুলো ফল্ট আছে। যেমন, হিমালয় পর্বতের মেইন ফ্রন্টাল থ্রাস্ট (এমএফটি) ফল্ট, মেঘালয়ের শিলং মালভূমির উত্তর পাশে ব্রহ্মপুত্র ভ্যালি ফল্ট বা ওধহাম ফল্ট, সিলেট-আসাম ফল্ট বা ইন্দো-ইউরেশিয়া প্লেটের সংযোগ লাইন, মিয়ানমার-চিটাগাং-ত্রিপুরা ফল্ট, মিয়ানমারের সাগাং ফল্ট, মধুপুর ফল্ট ইত্যাদি। এই ফল্টগুলো থেকে সৃষ্ট ভূমিকম্প যে কোনো মুহূর্তে বাংলাদেশের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ভারত ও মিয়ানমারও আছে ঠিক এরকম ঝুঁকিতে আছে। ফলে ওই দুই দেশে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পও বিপদের কারণ হতে পারে বাংলাদেশের জন্য।

১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল ভারত ও বাংলাদেশে। এর আগে ১৮৬৯ সালে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার, ১৮৮৫ সালে ৭ মাত্রার ও ১৯৩০ সালে ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৮৮৫ সালের ভূমিকম্পেই যমুনা নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে যায়। সাধারণত বড় একটি ভূমিকম্পের পরবর্তী দেড়শ’ থেকে আড়াইশ’ বছরের মধ্যে বড় আরেকটি ভূমিকম্প হয়। সে হিসাবেও বাংলাদেশ এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে অভিমত দেন বিশেষজ্ঞরা।

ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতার যে মাত্রা রয়েছে সে সূচক অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ শহরের অন্যতম। ভূমিকম্প ঝুঁকি অনুযায়ী ঢাকাকে চারটি এলাকায় ভাগ করা যায়। উত্তরা এলাকা সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং খিলগাঁও, বাড্ডা, গুলশান, ক্যান্টনমেন্ট এবং পুরনো ঢাকার বুড়িগঙ্গার আশপাশের অঞ্চল বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা।

আবার ভূমিকম্প: বাংলাদেশ সময় বুধবার রাত ১২টা ৪৯ মিনিটে আবার ৫ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগে মঙ্গলবার বেলা ৩টা ৯ মিনিটে ৫ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানীসহ সারাদেশ কেঁপে ওঠে। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের মাওলাইক এলাকার ৩৮ কিলোমিটার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল ৯৩.২ কিলোমিটার। বেলা ৩টায় যে ভূমিকম্প হয় সে সময় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। রাজধানীতে ভয়ে অনেককে ভবন ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে।

এদিকে কলকাতা প্রতিনিধি জানান, মঙ্গলবার বাংলাদেশের পাশাপাশি ৩টা ১১ মিনিটে কেঁপে ওঠে মনিপুর রাজ্য। যার কম্পনের মাত্রা ছিল ৫.৭। আতঙ্কিত শহরবাসীরা সবাই তখন নিজ বাড়ি অফিস কাচারি থেকে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। ভূমিকম্পের কারণে কমলপুর মহকুমা এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সালেমা, শান্তির বাজার, মানিক ভা-ার, নোয়াগাঁও, বালিগাঁও, বিলাশ ছড়া, মায়াছড়ি এবং গঙ্গা নগর এলাকায় বেশি ক্ষতি হয়েছে। এসব এলাকায় বাড়িঘর ভেঙে গেছে, গাছ পড়ে গেছে, বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। কমলপুর মহকুমার অধীনে মায়াছরি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় কমলেনি কন্দ নামের এক মহিলা আতঙ্কিত হয়ে দৌড় দেয়ার সময় হƒদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।