ঐতিহ্যবাহী কেরুজ চিনিকলের হাসপাতালটি হারিয়েছে জৌলুশ

চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা ॥ আধুনিকায়নের দাবি

 

দর্শনা অফিস: অব্যস্থাপনা আর অবহেলার কারণে দিন দিন বেহালদশায় পরিণত হয়েছে কেরুজ হাসপাতালটি। ১৯৩৮ সালে দেশের ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান এতদ্বা অঞ্চলের অর্থনৈতিক অন্যতম চালিকা শক্তি কেরুজ চিনিকল প্রতিষ্ঠার পরপরই মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্যসেবার কথা ভেবেই নির্মাণ করা হয় হাসপাতালটি। তৎকালীন সময়ে এতদ্বা অঞ্চলের স্বাস্থ্য সেবা ও চিকিৎসার একমাত্র মাধ্যম ছিলো কেরুজ এ হাসপাতাল। সে সময় হাসপাতালটির ছিলো রমরমা অবস্থা। এখন সে হাসপাতালটি হারিয়েছে জৌলুশ। চিকিৎসা সেবার সোনালী সে অতীত ঐতিহ্য হারিয়ে করুণদশায় পরিণত হয়েছে। শুয়ে বসে সময় পার করতে হয় হাসপাতালের স্টাফদের।

জানা গেছে, বাংলাদেশের শিল্প স্থাপনাগুলোর মধ্যে কেরুজ চিনিকল একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান। চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী জনপদ দর্শনায় চিনিশিল্প, ডিস্টিলারি ও বাণিজ্যিক খামারের সমন্বয়ে এ বৃহত্তর শিল্প কমপে¬ক্সটি প্রতিষ্ঠিত। ১৮০৫ সালে মি. জন ম্যাক্সওয়েল নামক এক ইংরেজ তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের কানপুরে জাগমু নামক স্থানে একটি মদের কারখানা চালু করেছিলেন। সময়ের বিবর্তনে এ প্রতিষ্ঠানের নাম, স্থান, মালিকানা, উৎপাদন ও ব্যাবসায়িক কর্মকা- পরিবর্তীত ও পরিবর্ধিত হতে থাকে। ১৮৪৭ সালে মি. রবার্ট রাসেল কেরুর সাথে অংশীদারত্বে যুক্তহন। এর কিছুদিনের মধ্যে তার অংশ বিক্রি করে দেন। ১৮৫৭ সালে ভারতের রোজতে সিপাহী বিপ¬বের সময় প্রতিষ্ঠানটি ক্ষতিগ্রন্ত হয়। অতঃপর তা পুনঃনির্মাণ পূর্বক জয়েন্ট স্টক কোম্পানি গঠন করে কেরু অ্যান্ড কো. লি. হিসাবে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয়। রোজতে ব্যবসায় উন্নতি লাভ করলে আসানসোল ও কাটনীতে এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এ অঞ্চলে মাটি ও আবহাওয়া আখচাষের উপযোগি হওয়ায় ১৯৩৮ সালে মিলটি স্থানান্তর করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে দর্শনায়। চিনিকল প্রতিষ্ঠার পরপরই এ অঞ্চলের আখ-চাষি, মিলের শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের স্বাস্থ্য সেবার কথা ভেবে মিল কর্তৃপক্ষ স্থাপন করে ২০ শয্যা বিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা ছিলো চোখে পড়ার মতো। এ অঞ্চলে তেমন কোন চিকিৎসা কেন্দ্র ও ভালো চিকিৎসক না থাকায় সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কেরুজ শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তারা চিকিৎসা সেবার জন্য ভিড় জমাতো কেরুজ হাসপাতালে। চিকিৎসা সেবার পাশপাশি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ করতো। নিময়মাফিক হাসপাতালে কর্মরত ৩ জন চিকিৎসকসহ ২৫-২৬ জন স্টাফ চিকিৎসা সেবা কাজে নিয়োজিত থাকতেন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও ২ জন চিকিৎসক কর্মরত থাকতেন। প্রায় ১ যুগ ধরে ২ জন চিকিৎসকের স্থলে দেখা মিলে ১ জনকে। সে থেকে একজন চিকিৎসকই দিচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা। বর্তমান অবস্থার তার পুরোটাই উল্টো। এখন ৩ শিফটে মাত্র ১ জন চিকিৎসকই দায়িত্ব পালন করছেন। চিকিৎসকের বাড়ি জীবননগর হওয়ায় তিনি প্রায় সময় বাড়িতে যাতায়াত করে থাকেন। নেই কোনো জরুরি ব্যবস্থা। রোগী সাধারণ নেই বললেই চলে। আর এ ধরনের পরিণতির কারণ চিকিৎসা সেবা ব্যবস্থা নড়বড়ে। অভিযোগ উঠেছে, কেরুজ হাসপাতালে সবসময় ৩ জন চিকিৎসক, ১ জন কম্পাউন্ডার, ১ জন ড্রেসার, ২ জন নার্স, ১ জন আয়া, ১ জন ওয়ার্ডবয় ও ১ জন মিউওয়াইফ ও ৩ জন সুইপার থাকার কথা থাকলেও চিকিৎসক রয়েছেন ১ জন এবং স্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক ২ জন নার্স। ফলে ১ জন চিকিৎসককেই ২৪ ঘণ্টা চিকিৎসা সেবায় ব্যস্ত থাকতে হয়। নার্স নিয়োগের প্রক্রিয়া সে কবে থেকে চলছে। তবে নাগাদ নিয়োগ সম্পন্ন হবে তা অজানায় রয়েছে। নিয়োগকৃত চিকিৎসক শাহিনুর হায়দার প্রায় ২৫-২৬ বছর কর্মরত রয়েছেন কেরুজ হাসপাতালে। তবে জরুরি চিকিৎসার জন্য কোন রোগী হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসকের সাথে সাধারণ নার্স মোবাইলে যোগাযোগ করে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেয়ার অভিযোগো রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার এখানে আরো চিকিৎসক নিয়োগ দিলেও অজ্ঞাত কারণে কেউ আসেননি আবার কেউ কেউ এসেও থাকেননি। নিয়োমিত চিকিৎসক না থাকালে কেউ কেউ বিভিন্ন তালবাহানায় হাসপাতালে কর্মরত না থেকে এখানে-সেখানে আড্ডা দিয়ে সময় পার করে থাকে বলেও জনশ্রুতি রয়েছে। তবে এ হাসপাতালে এখনো প্রতি সপ্তাহে কোম্পানির পক্ষ থেকে দেড় হাজার টাকার ওষুধ বরাদ্দ দেয়া হয়। যা চাহিদার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। বর্তমানে চিকিৎসা সেবায় ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। দর্শনাসহ আশপাশ এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ক্লিনিক। সেসকল আধুনিক ক্লিনিকের তুলনায় কেরুজ হাসপাতালটি সেকেলেই রয়ে গেছে। হাসপাতালটি অতীত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবস্থা করা জরুরি। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন অপরেশন থিয়েটার, সার্জিক্যাল চিকিৎসক, নিয়মিত চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সংশি¬ষ্ট কর্তাবাবুর তদারকি। তাহলে হয়তো অনেকেই অল্প খরচে ভালো চিকিৎসা সেবা নিতে পারবে কেরুজ হাসপাতাল থেকে। সচেতনমহল এ রকমই দাবি তুলে বলেছে, শ্রমিক-সাধারণ ও এলাকার আখচাষিদের চিকিৎসার কথা ভেবেই চিনিকল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালটি আধুনিকায়ন করে উন্নত সেবার মধ্যদিয়ে পরিচালিত করবে।