সুযোগ পেলে তোষামোদকারীদের সৃষ্ট বলায় বদলে দেয় প্রকৃত দৃশ্যপট

 

 

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন এখন আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও নির্বাচন পদ্ধতি প্রণয়নের শুরুতে বর্তমানের মতো জনপ্রতিনিধি বা গোষ্ঠীর কর্তা নির্ধারণ হতো না। তখন ধরণ বরণও ছিলো ভিন্ন। সময়ের ¯্রােতে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই গোপন ব্যালটে অধিকর্তা বা প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য অভিমত দেয়ার মধ্যে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী বা সমাজের উপযুক্ত সদস্য নিগুড়ভাবে অংশীদারত্বটাও নিশ্চিত করতে পেরেছে। যদিও ক্ষমতার অপব্যবহার এই অংশীদারত্বের গৌরবে ঘুরে ফিরে আঘাতও হানে। আমাদের জাতীয় জীবনে এর উদাহরণের অভাব নেই। যে সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা রাজনৈতিক দলগুলো দলের অভ্যন্তর থেকে সর্বক্ষেত্রে সুবিন্যাস্ত করতে পেরেছে সেই সমাজ সত্যিকার গণতন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে। আমরা? একটি দুটি ভোট দেখি। আশায় আশায় বুক বাধি।

গণতন্ত্র পিপাসু সর্ব সাধারণের সবসময়ই প্রত্যাশা, ক্ষমতার প্রভাবমুক্ত শক্ত মেরুদ-ের দক্ষ নির্বাচন কমিশন। আসন্ন জাতীয়  নির্বাচনের প্রস্তুতিরই অংশ হিসেবে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে দেশের অন্যতম বৃহৎ দলসহ বিরোধী আসনে বসা ছোট-বড় দলগুলোর প্রস্তাবনায় অভিন্ন এই প্রত্যাশারই প্রতিফলন ঘটেছে। এর মাঝে একদিন আগেই সার দেশে জেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হলো। এ নির্বাচনে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত করেছেন তাদের প্রতিনিধি বা অধিকর্তা। আমজনতার মতামত দেয়ার সুযোগ না দেয়ার প্রশ্নটি অবশ্য অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। এরপরও অন্যতম বৃহৎ জোটভুক্ত দলের অংশগ্রহণ ছাড়াই ক্ষমতাসীনদলের সমর্থিতের সাথে অসমর্থিতের লড়াই অধিকাংশ জেলায়-ই বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ ছিলো তার অন্যতম। ঝিনাইদহে ক্ষমতাসীনদল আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচিত হলেও মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গায় সংবাদপত্রের ভাষায় বিদ্রোহীদের জয়জয়কার। তবে কি ক্ষমতার সাথে ক্ষমতার সংঘাত? নাকি ক্ষমতা সমবণ্টনের যথাপোযুক্ত প্রতিনিধি নির্বাচনে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত? না, তা হবে কেন? বিজিতের প্রাপ্ত ভোট সংখ্যা তো আর শূন্য নয়। নির্বাচন এমন এক পদ্ধতি, ক্ষমতার মসনদে অসীন হওয়ার জন্য মতামতের যজোন যজোন ফারাকের দরকার হয় না, দু-একটি ভোটের ব্যবধানই যথেষ্ঠ। কেননা, নির্বাচনী ফলাফল নির্ধারণ করা হয় অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে। যদিও নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে পৃথক থাকলে চলে না, সকলেরই হতে হয়। তা না হলে কি তাকে নেতা হওয়া মানায়? নেতাকে সব সময়ই মনে রাখতে হয়, তিনি সকল মানুষের সমষ্টি। জেলা পরিষদ নির্বাচনে নির্বাচিত সকলে নিশ্চয় বিষয়টি মনে রাখবেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সেখ সামসুল আবেদীন খোকন ভোটের পরদিনই বিজিত প্রার্থীর বাড়িতে হাজির হয়ে কুশল বিনিময় করে দায়িত্বপালনে সহযোগিতা চেয়ে খাটো হননি বরঞ্চ বড় মনের পরিচয় দিয়েছেন। ইতিবাচক দৃষ্টিতে সেটাই। অন্যদৃষ্টিতে? যদিও নির্বাচনে পরাজয়ের কষ্ট প্রথম পর্যায়ে এতোটাই তীব্র থাকে যে, বিজয়ীর কর্মদন কারো কারো কাছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতোই মনে হয়। তারপরও মেনে নিতে হয় হাসি মুখে। কষ্ট লুকোতে হয় কষ্ট করে ঠোঁটে ফোটানো হাসির রেখায়। কেননা, নেতাকে কি কষ্টে কুকড়ালে চলে? চলে না। তাছাড়া নির্বাচিতদের ক’জনই আর পরাজিতকে পাশে নিয়ে সমাজের অগ্রযাত্রা ত্বরানিত করেন? অলিক স্বপ্নের মাঝেও যে কিছু ব্যতিক্রম হয় না তাও নয়। যেমন এবারই জেলা পরিষদ নির্বাচনে চমৎকার সব উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। মাদারীপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে পদপ্রার্থী একাই প্রায় সব ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে এক ইতিহাস গড়েছেন। আবার কোনো কোনো জেলায় অনেক প্রার্থীকেই ভোটশূন্য হয়েও সন্তোষ প্রকাশ করে নির্বাচনকে সুষ্ঠু সুন্দর বলে অখ্যায়িত করতে দেখা গেছে।

না, শুধু জেলা পরিষদ নয়, কোনো নির্বাচনেই নির্বাচিতকে তোশামেদ নয়। সংবর্ধিত তখনই হওয়া উচিত যখন তিনি সংবর্ধিত হওয়ার মতো কাজ করেন। যিনি কাজ করার জন্য দায়িত্ব নিলেন, তিনি দায়িত্ব পেয়েই যদি তোষামোদে গদ গদ হন, সংবর্ধনার বানে ভাসতে থাকেন তাহলে তার সামনে তোষামোদকারীদের সৃষ্ট বলায়ে প্রকৃত দৃশ্যপটই তো অদৃশ্য হয়ে যাবে। নির্বাচিত অধিকর্তাদের পরবর্তী নির্বাচনে কষ্টের কারণ মূলত ওই তোষামোদকারীদের প্রশ্রয়। জেলা পরষদ নির্বচনে সকল নির্বাচিত প্রকৃত দায়িত্ব পালনে আন্তরিক হোক। প্রশংসিত হওয়ার মতো ভালো কাজ করতে সক্ষম হোক। এ প্রত্যাশার পাশাপাশি কায়মনে কামনা, সর্বক্ষেত্রে সকল ভোটারের ভোটাধিকার অভয়ে প্রয়োগের পরিবেশ গড়ে তোলার মতো শক্ত মেরুদণ্ডের দক্ষ নির্বাচন কমিশন।