গাইবান্ধার এমপি লিটনকে গুলি করে হত্যা : আটক ৩

মোটরসাইকেলে এসে বাড়িতে ঢুকে তিন দুর্বৃত্তের কিলিং মিশন

 

স্টাফ রিপোর্টার: গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগের এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটনকে নিজ বাসভবনে ঢুকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় এমপির নিজ বাড়ি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গায় তাকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে পালিয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তার মৃত্যু হয়।f1-n1-2015-10-09

এদিকে এ ঘটনায় শোক প্রকাশ করে জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় সভানেত্রীর নির্দেশে গতকাল শনিবার রাতেই গাইবান্ধার উদ্দেশে রওনা হন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। অন্যদিকে ঘটনার পর সুন্দরগঞ্জে জামায়াত নেতা আবদুল গফফারের ওষুধের দোকানে আগুন দিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে লিটনের সমর্থক ও আওয়ামী লীগের কর্মীরা।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. বিমল চন্দ্র রায় সাংবাদিকদের জানান, এমপি লিটনের বুকের ডান ও বাম পাশে এবং ডান হাতে গুলি লেগেছে। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে তার মৃত্যু হয়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

ঘটনার বিষয়ে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, এমপি লিটনের স্ত্রী ফোন করে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি পুলিশকে জানান। খবর পেয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গেছেন। ঘটনাটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে আটক করা হয়েছে। আটকদের নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, কর্তাদের নির্দেশে ঘটনার পর থেকে অভিযানে আছে পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম। পরে আটকদের নাম ও অভিযানের বিষয়ে জানানো হবে।

সুন্দরগঞ্জ থানার পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, এমপি মনজুরুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় নিজ বাড়ির বৈঠকখানার সোফায় বসেছিলেন। এ সময় দলের কয়েকজন নেতাকর্মী ওই কক্ষে ছিলেন। সন্ধ্যা ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে একটি মোটরসাইকেলে অজ্ঞাত ৩ যুবক এমপি লিটনের বাড়িতে যায়। আততায়ীদের সবার মাথায় হেলমেট ছিলো। এদের মধ্যে একজন মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। অপর দুজন বৈঠকখানায় ঢুকে এমপিকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় ঘরের মধ্যে থাকা অন্যরা ছোটাছুটি করে বেরিয়ে যায়। দুর্বৃত্তরা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে ওই মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়।

এমপি লিটনের স্ত্রী খুরশীদ জাহান হক স্মৃতি জানান, আমি রান্নার কাজে অন্য রুমে ব্যস্ত ছিলাম। হঠাত গুলির শব্দ শুনে অতিথি কক্ষে এসে দেখি তিনি মাটিতে পড়ে রয়েছেন। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এমপি লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এমপির শরীরে ৭টি গুলি লাগে। এর মধ্যে বুকে ও পেটে ৪টি, ডান হাতে দুটি ও উরুতে একটি গুলি লাগে। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এদিকে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে সুন্দরগঞ্জে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। দলীয় নেতাকর্মীরা হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। উপজেলা সদরসহ তার গ্রামের বাড়ি শাহবাজ ও সংলগ্ন বামনডাঙ্গা এলাকায় দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। উত্তেজিত নেতাকর্মীরা হত্যাকাণ্ডের জন্য জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করে স্লোগান দিয়ে মিছিল থেকে জামায়াত সমর্থক আবদুল গফফারের দুটি ওষুধের দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। গোবিন্দগঞ্জেও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা এ ঘটনার প্রতিবাদে রাতেই বিক্ষোভ করে। গাইবান্ধা জেলায় আতঙ্ক ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।

মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনকালে তিনি সাহসী ভূমিকা পালন করেন। উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আহমেদ জানান, জঙ্গিবাদ ও জামায়াত-শিবির বিরোধী অবস্থান নেয়ায় তিনি একটি মহলের রোষানলে পড়েন। তারাই লিটনকে হত্যা করেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ নেতা গাইবান্ধা পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলন বলেন, সুন্দরগঞ্জের রাজনীতিতে মৌলবাদী চক্রের ধংসযজ্ঞের রাজনীতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে লিটনের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। সে কারণেই আততায়ীরা তাকে টার্গেট করে হত্যা করেছে।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক জানান, লিটনের মৃত্যুর খবর পেয়ে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক এমপির নেতৃত্বে একটি দল আজ রোববার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে আসছেন।
তার পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, তার একমাত্র ছেলে রাতিন বাবু এবার ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এ লেবেল পাস করেছে। এ খবর লেখা পর্যন্ত রংপুর মেডিকেল কলেজের মর্গে তার লাশ ছিল। তার স্ত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতিসহ অন্য আত্মীয়স্বজনরা হাসপাতাল চত্বরে আহাজারি করছিলেন।

উল্লেখ্য, সুন্দরগঞ্জের শিশু শাহাদাত হোসেন সৌরভকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন। তিনি জামিনে ছিলেন। ২০১৫ সালের ২ অক্টোবর সকালে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গোপালচরণ গ্রামের বাড়ির পাশের সড়কে চাচার সাথে হাঁটতে বের হয় শিশু সৌরভ। তখন সে এমপি লিটনের গুলিতে আহত হয়। এ ঘটনায় সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় ব্যাপক আন্দোলন হয়। ৩ অক্টোবর রাতে শাহাদাতের বাবা সাজু মিয়া হত্যাচেষ্টা ও গুরুতর জখমের অভিযোগে এমপি লিটনের বিরুদ্ধে সুন্দরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। ওই দিনই সন্ধ্যায় এমপি তার আত্মীয়ের মাধ্যমে দু’টি অস্ত্র থানায় জমা দেন। ৬ অক্টোবর রাতে বসতবাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগে উপজেলার উত্তর শাহবাজ গ্রামের হাফিজার রহমান মণ্ডল বাদী হয়ে এমপিকে প্রধান আসামি করে মোট ১০ জনের বিরুদ্ধে একই থানায় আরেকটি মামলা করেন। ১৪ অক্টোবর রাতে গ্রেফতার হন তিনি। পরে তিনি জামিন পান।

আততায়ীর গুলিতে নিহত মো. মনজুরুল ইসলাম লিটন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাইবান্ধা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৮ সালের ১ জানুয়ারি গাইবান্ধা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা আশরাফ আলী এবং মাতা আলতাফুন্নেছা। তিনি গাইবান্ধা সুন্দরগঞ্জ উপজেলা শাখা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দশম জাতীয় সংসদে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মনজুরুল ইসলাম লিটন ‘আশরাফ সীড স্টোর লি. এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ‘আনন্দ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এর পরিচালক। লিটন এক ছেলে সন্তানের জনক।