নারী জঙ্গির আত্মঘাতী বিস্ফোরণ : নিহত ২

 

রূপনগরে নিহত জঙ্গি জাহিদের স্ত্রীসহ চারজনের আত্মসমর্পণ

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর পূর্ব আশ-কোনায় সন্দেহভাজন জঙ্গিদের আস্তানায় পুলিশের অভিযানের সময় আত্মঘাতী গ্রেনেড বিস্ফোরণে এক নারীসহ দুইজন নিহত হয়েছেন। এরা হলেন- জঙ্গিনেতা তানভীর কাদেরীর ১৪ বছর বয়সী ছেলে আদর ও পলাতক জঙ্গি সুমনের স্ত্রী শাকিনা (৩৫)। এছাড়া বিস্ফোরণের সময় স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হয়েছে সাবিনা (৪) নামের একটি শিশু। তার বাবা জনৈক জঙ্গি ইকবাল বলে দাবি করছে পুলিশ। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। চিকিত্সকরা জানিয়েছেন তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। নিহত দুই জঙ্গি ও শিশুটির বিস্তারিত পরিচয় পুলিশ জানাতে পারেনি। নিহত আদরের লাশ পড়ে আছে ঘটনাস্থলে। জঙ্গি শাকিনার লাশ ময়নাতদন্তের জন্য রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া অভিযান শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর আস্তানা থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশের কাছে ধরা দেন নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষনেতা সাবেক সেনা কর্মকর্তা নিহত মেজর জাহিদের (চাকরিচ্যুত) স্ত্রী জেবুন্নাহার শিলা ও তার মেয়ে এবং পলাতক জঙ্গি মুসার স্ত্রী তৃষা ও তার মেয়ে। তাদের কাছ থেকে একটি পিস্তল ও ৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। আত্মসমপর্ণকারী শিলা ও তৃষাকে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল শনিবার দক্ষিণখানের পূর্ব আশকোনায় হজক্যাম্পের কাছে তিন তলা একটি বাড়িতে (সূর্যভিলা) অভিযান চালায় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের নেতৃত্বে সোয়াট টিম। এই অভিযানের নাম দেয়া হয়েছে অপারেশন রিপল ২৪। শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টা থেকে অভিযান শুরু হয়। অভিযান শেষ হয় গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটায়। অভিযানের সময় জঙ্গিদের আত্মঘাতী বিস্ফোরণে বোমা ডিসপোসাল ইউনিটের ইন্সপেক্টর শফি আহমেদসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

জানা গেছে, নিহত আদরকে এলাকাবাসী শহীদ কাদেরী নামে চিনত। গত ১০ সেপ্টেম্বর আজিমপুরের একটি বাড়িতে অভিযানের সময় তানভীর কাদেরী আত্মহত্যা করেন। কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা এবং তার জমজ ছেলেদের একজন (আবির) আজিমপুরের ওই অভিযানের সময় আহত অবস্থায় গ্রেফতার হন। অভিযান সম্পর্কে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ওই বাড়ির মধ্যে একটি লাশ পড়ে রয়েছে, সেটা রবিবার সকালে উদ্ধার করা হবে। তবে বাইরে থাকা নারীর লাশটি আইনগত কাজ শেষ করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, বাসাটির ভেতরে গ্যাস ও বিস্ফোরক রয়েছে। তাই রাত হয়ে যাওয়ায় ভেতরে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। কাল (রবিবার) সকাল থেকে ফের আমাদের বোমা ডিসপোজাল টিম কাজ করবে। বাড়িটি পুলিশ পাহারায় রয়েছে। ওই বাড়ির বাকি লোকদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সকাল দশটার দিকে সাংবাদিকদের বলেন, দফায় দফায় আত্মসমর্পণ করতে বলার পর ওই চার জন পুলিশের কাছে ধরা দেন। তারা একটি পিস্তল ও ছয় রাউন্ড গুলিও পুলিশের কাছে জমা দেন।

অভিযান সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: গতকাল বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও পুলিশ প্রধান একেএম শহীদুল ইসলাম ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের সামনে অভিযানের সমাপ্তির কথা জানান। এসময় তিনি বলেন, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে তাদের অবস্থান জানতে পেরে পুলিশ এখানে অভিযান চালায়। বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গি মুসা। আমরা জঙ্গিদের আহ্বান করেছি, তোমাদের অবস্থান থেকে সারেন্ডার করো। আমাদের পুলিশ বাহিনী তাদের সাথে নেগোসিয়েশন করেই যাচ্ছিলো। তারা চরম ধৈর্য দেখিয়েছে। তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে করতেই এক সময় সুমনের স্ত্রী শাকিনা (বোরকা পরা) হঠাত্ করে বেরিয়ে আসার কথা বলে। পরে শিশু মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসে সে। তার গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট বাধা ছিলো। তাতে তাজা গ্রেনেড ছিলো। পুলিশ তাকে ওই ভেস্ট পরে না আসার জন্য নির্দেশ দেয়। কিন্তু ওই নারী ভেতরে গিয়ে আবার একই ভাবে বেরিয়ে আসে। এক পর্যায়ে সুইসাইডাল ভেস্টের সুইচ ধরে টান দেয়। এতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই ওই নারী মারা যান। সঙ্গে থাকা শিশুটি গুরুতর আহত হয়। পুলিশ শিশুটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এরপরও বাড়ির ভেতরে একটি ছেলে ছিলো। সে কিছুতেই আত্মসমর্পণ করছিলো না। তাকে আত্মসমর্পণের অনুরোধে কাজ না হলে পুলিশ ভেতরে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এরপর সে গুলি করতে শুরু করে। তার কাছে গ্রেনেড ছিল। সেগুলো ছুড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে পুলিশ তার অবস্থান লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করলে ভেতর থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়। পরে তাকে নিহত অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায়।

এদিকে আশকোনা এলাকার এক কিশোর দোকানি বলেন, নিহত আদরের (কাদেরী নামে জানত) সাথে তার সখ্য গড়ে ওঠে ছিলো। মাঝে মধ্যে আদরের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে ওই বাড়িতে যেতো। সে আমাকে ধর্মীয় গান শোনাতো ও জিহাদের কথা বলতো। রাতে প্রায়ই আমাকে তার বাসায় থাকতে বলত। বলত- ধর্ম নিয়ে কথা আছে। গত ১৫ ডিসেম্বরও আদরের সাথে তার কথা হয়। সেদিন সে আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে জিহাদে যোগ দিতে বলে। সে বলে- ইসলামের পথে আসতে হবে, বন্দুক হাতে নিতে হবে, জিহাদ করতে হবে। অভিযানে থাকা কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের কর্মকর্তা অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, বোরকা পরা ওই নারী শিশুটিকে হাতে ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন। বাইরে এসে তিনি হাতটি একটু উঁচু করে তারপরই নামিয়ে বিস্ফোরণ ঘটান। পুলিশ তখন কাউকে সেদিকে ভিড়তে না দিলেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গিয়েছিলো। স্থানটি ধোঁয়ায় ভরে যেতেও দেখা যায়। ওই নারীর দেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ওই বাড়ির গাড়ি বারান্দায় পড়ে থাকে। ভেতরে আদর সশস্ত্র অবস্থায় থাকায় পুলিশ প্রথমে ওই নারীকে উদ্ধার করতে যেতে পারেনি।

সূর্যভিলার মালিকের মেয়ে জোনাকি রাসেল বলেন, তার বাবা মোহাম্মদ জামাল হোসেন বাড়িটির মালিক। তিনি কুয়েত প্রবাসী। দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। তিনি বাবার বাড়ির কাছেই আরেকটি বাড়িতে থাকেন। তিনি বলেন, ইমতিয়াজ আহমেদ নামে এক ব্যক্তি চলতি বছরের ১ সেপ্টেম্বর দশ হাজার টাকা মাসিক চুক্তিতে বাসাটি ভাড়া নিয়েছিলো। ভাড়া নেয়ার সময় ওই ব্যক্তি জানান, তিনি অনলাইনে বেচাকেনা করেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাসায় থাকবেন। তবে মাঝে মধ্যে তার বোন আসা-যাওয়া করবে। এরপর ৩ সেপ্টেম্বর তারা বাসা ওঠে। তবে তারা বাসা থেকে কম বের হতো। শান্ত-শিষ্ট ছিলো বলে তাদের কখনও সন্দেহ হয়নি। তিনি আরো বলেন, বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় পরিবারটি জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি দিয়েছে, ভাড়াটে সংক্রান্ত ফরম পূরণ করেছে এবং সে ফরম থানায় জমা দেয়া হয়েছে।

সাবিনার অবস্থা আশঙ্কাজনক: দক্ষিণখান থানার এসআই ফেরদৌস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, বোমার স্প্লিন্টার সাবিনার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্ধ হয়েছে। ক্যাজুয়ালিটি বিভাগের ডিউটিরত চিকিত্সক আতাউর ইসলাম জানান, শিশুটির পেট? বুকসহ বিভিন্ন স্থানে বোমার স্প্লিন্টারের আঘাত রয়েছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

উল্লেখ্য, গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর ঢাকা এবং এর আশপাশে কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালায় র‌্যাব-পুলিশ। এতে তামিম, জাহিদ, কাদেরীসহ ৩৫ জন নিহত হন। অপরদিকে দেশে নারী জঙ্গিদের আত্মঘাতী ঘটনা এটিই ঘটনা।

সূর্যভিলার ওই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে স্থানীয় আল বাছির জামে মসজিদে নামাজের পর পর আদর মুসল্লিদের সাথে প্রতিদিনই ইসলামিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো। পাশের বাড়ির মালিকের ছেলে রাজিব জানান, আদরকে প্রতিদিন নামাজের সময় দেখা যেতো। তার চলাচলে আমরা বুঝতে পারি নাই সে জঙ্গি কি-না, তাছাড়া সে কারো সাথে অকারণে কথা বলতো না। গত শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে ওই বাড়ি থেকে বিকট আওয়াজ পেয়ে আমিসহ আশপাশের লোকজন ঘর থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করি। এ সময় রাস্তায় অনেক পুলিশ দেখে আবার ঘরে চলে যাই। কিছুক্ষণ পরে মসজিদের মাইকে শুনি জঙ্গিদের ঘিরে ফেলেছে পুলিশ।