সরেজমিন থেকে ফিরে স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার জাফরপুর বিজিবি ক্যাম্পের অদূরের প্রত্যয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রটির রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনিয়ম। এরপরও মাদকাসক্তি মুক্তির আশায় ওখানে ভর্তি এখনও ১৯ জন। সার্বক্ষণিক যে চিকিৎসকের থাকার কথা, সেই চিকিৎসক ডা. নাহিদ ফাতেমাকে নিরাময় কেন্দ্র এলাকার তেমন কেউই কখনো দেখেননি বলে জানিয়েছেন। অপরদিকে কুলাঙ্গার সন্তানের ভয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ঝিনাইদহ রাঙ্গিয়ারপোতার আমিরুল ইসলাম (৬৫)। তিনি বলেছেন, যে ছেলেকে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে লেখাপড়া শেখালাম, বিদেশে পাঠালাম সেই একমাত্র ছেলে দেশে ফিরে সম্পদ সম্পত্তির লোভে আমাকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে বন্দি করে রাখলো? ৮ দিন প্রকোষ্ঠ অন্ধকার ঘরে বন্দি অবস্থায় কেমন কেটেছে এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বার বার চোখ মুছেছেন হতভাগা পিতা আমিরুল ইসলাম।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সদরের জাফরপুর বিজিবি ক্যাম্পের ১ নং গেটের বিপরীতেই প্রত্যয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র। বছর দেড় আগে যার নাম ছিলো প্রত্যাশা। এ কেন্দ্রে একজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আটকে নির্যাতন করার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে নাম বদলানো নিরাময় কেন্দ্রে শর্ত মোতাবেক একজন চিকিৎসক সার্বক্ষণিক থাকার কথা। ডা. নাহিদ ফাতেমাকে সার্বক্ষণিক, ডা. কামরুল হুদাকে খণ্ডকালীন ও মহাদেব চন্দ্র মণ্ডলকে মনোচিকিৎসক হিসেবে দেখিয়ে অনুমোদন নেয়া। অবাক হলেও সত্য যে, প্রত্যয়ে চিকিৎসকের দেখা মেলে না। তাছাড়া অবকাঠামোও অস্বাস্থ্যকর। অভিযোগ রয়েছে, এ কেন্দ্রে ভর্তি রোগীদের জন্য সংগ্রহ করা মাদক কৌশলে বিক্রিও করা হয়। অবশ্য গতকাল সরেজমিন দেখতে গেলে সেখানে কর্তব্যরত প্রত্যয়ের অংশীদার (অর্থ) সোহেল রানা তা অস্বীকার করেন। সার্বক্ষণিক চিকিৎসক কোথায়? তিনি বলেন, লাঞ্চে গেছেন। বিকেল ৪টার সময় লাঞ্চ? ওই চিকিৎসকের নাম কী? প্রতিষ্ঠানের একজন অংশীদার হয়েও তিনি সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের নাম বলতে পারেননি। অথচ অনুমোদনের সময় ডা. নাহিদ ফাতেমাকে দেখানো আছে। প্রত্যয়ের অংশীদার (মার্কেটিং) আবদুল আলিম এক সহযোগীসহ বর্তমানে জেলহাজতে। এই আলিমই সরোজগঞ্জ বাজার থেকে গত ২২ নভেম্বর কলার ধরে মাইক্রোবাসে তোলে রাঙ্গিয়ারপোতার বৃদ্ধ আমিরুল ইসলামকে। আমিরুল ইসলামের একমাত্র ছেলের প্ররোচনায় তকে ওই নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে আটকে রাখা হয়। আমিরুলকে বন্দি করে তার একমাত্র ছেলে জমিজমা লিখে নেয়ার চক্রান্ত করেছিলো। সহযোগিতা করেছে প্রত্যয়ের আলিমসহ তার সহযোগীরা। এ অভিযোগে মামলা হয়েছে। আমিরুলের ছেলে জাহিদুল ইসলাম পলাতক রয়েছে। গতকাল সরেজমিন গেলে গ্রামবাসী জানায়, ডাকবাংলা পুলিশ তাকে হাতের কাছে পেয়েও পরশু গ্রেফতার করেনি। পরশুর পর থেকে আত্মগোপন করেছে।
রাঙ্গিয়ারপোতার আমিরুল ইসলামের নিকট বিস্তারিত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, তিন মেয়ে এক ছেলের জনক আমি। ছেলেমেয়ে সকলকেই লেখাপড়া করিয়েছি। অকম্মা ছেলেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ করে বছর দেড়েক আগে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছিলাম। মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে, ওরা সকলেই চাকরি করে। ভালো আছে। দেড়মাস আগে মালয়েশিয়া থেকে ফিরে আসে ছেলে জাহিদ। বিদেশে দেড় বছর থেকে টাকা রোজগার করতে না পারা ছেলে যখন জমিজমা লিখে দিতে বলে তখন তাকে বলেছিলাম একমাত্র ছেলে। সবই তো তোমার। লিখে দিতে হবে কেন? ওর মাও ওরপক্ষ নেয়। বাপের বাড়ি গিয়ে ওঠে। এরই মাঝে গত ২২ নভেম্বর সরোজগঞ্জ বাজারের একটি জুতোর দোকানে বসে ছিলাম। ছেলে এসে বললো দুলাভাই এসেছে। তোমার সাথে কথা বলবে। দোকান থেকে বের হতে না হতেই সামনে মাইক্রোবাস থেকে কয়েকজন নেমে আামকে মাইক্রোবাসে তোলে। কলার ধরে টানাহেঁচড়া করে। তখন মনে হয়েছিলো আমাকে ওরা মেরে ফেলবে।
তারপর কি হলো? তিনি বললেন, মাইক্রোবাস বিজিবি ক্যাম্পের নিকট ওই বাড়ির সামনে থামলো। নামিয়ে ওই বাড়ির একটি অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখা হলো। কখন রাত হয়েছে কখন দিন হয়েছে বোঝার উপায় ছিলো না। কেননা, যে ঘরে রাখা হয়েছিলো সেখানে থেকে বাইরের কিছু দেখা দূরের কথা আলো-বাতাসই ঠিকমতো পাওয়া যেতো না। একবার রুটি ভাজি, বাকি দু বেলা শাকভাত। এর মাঝে কয়েক ওয়াক্ত মাছও দিয়েছে। ৮ দিনের মাথায় যখন কয়েকজন আমাকে বের করে আনলেন, গাড়িতে তুললেন তখনও বুঝিনি আমাকে উদ্ধার করা হয়েছে। থানায় নেয়ার পর স্বস্তি পাই। তখন পুলিশকে সব খুলে বলি। মামালা করি।
প্রসঙ্গত, ১ ডিসেম্বর দুপুরে জাফরপুরের প্রত্যয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে চুয়াডাঙ্গা পুলিশের একটি দল আমিরুল ইসলামকে উদ্ধার করে। আমিরুল ইসলামকে তার ছেলে জাহিদ চক্রান্ত করে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে বন্দি করে জমিজমা লেখে নেয়ার চেষ্টা করে। গ্রামে ফিরে প্রথমে পিতা অপহৃত হয়েছে বলে জানালেও প্রতিবেশীসহ আত্মীয়স্বজনের চাপের মুখে জাহিদুল বলে, বাবা নেশাখোর। তাকে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয়েছে। এরপরই বিষয়টি জানানো হয় পুলিশে। পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ায় উদ্ধার হয় আমিরুল ইসলাম।