সস্তায় বিভিন্ন দামী সামগ্রী দেয়ার প্রলোভনে মানুষকে ঠকাচ্ছে একটি চক্র

চুয়াডাঙ্গায় এমএলএম কোম্পানির আদলে পিএইচআর ইলেকট্রনিক্স ও ফার্নিচার মেলার নামে অভিনব প্রতারণা 

 

ফাইজার চৌধুরী: ১ হাজার টাকা মূল্যের একটি কার্ড ঘষে মাত্র ৬ হাজার ৩৮০ টাকা দিলেই মিলছে চকচকে নামি ব্রান্ডের এলইডি টিভি। সেই সাথে ১০-১৫টি স্ক্র্যাচ কার্ড। প্রতিটি স্ক্র্যাচ কার্ড বিক্রি করা যাবে ১ হাজার টাকায়। করাও হচ্ছে! ওই স্ক্র্যার্চ কার্ড যারা কিনছেন, ঘষাঘষি করে তাদের প্রত্যেকের মিলছে ১৭ থেকে ১৯ ইঞ্চি মাপের এলইডি টিভি। তাহলে ফলাফল কী দাঁড়ালো? বিনামূল্যে একটি ১৭ থেকে ১৯ ইঞ্চি টিভিতো মিলছেই। উপরোন্ত ৩ হাজার টাকা লাভ! মূল কথা হলো এর পুরোটাই প্রতারণা। প্রতারকের এই ফাঁদে ইতোমধ্যে পা দিয়েছেন চুয়াডাঙ্গাসহ আশপাশের এলাকার প্রায় হাজার দেড়েক মানুষ। বিক্রি হয়েছে প্রায় ২ হাজার নকল এলইডি টিভি। স্ক্র্যাচ কার্ডে মোটরসাইকেল, ফ্রিজ, স্যামসাং মোবাইলফোন, ৪২ ইঞ্চি এলইডি টিভি ও বিভিন্ন ধরনের ফার্নিচারের ছবি দেয়া থাকলেও ১শটি কার্ড ঘষলেও জুটছে একই পণ্য। আর তা হচ্ছে img১৭ অথবা ১৯ ইঞ্চি নিম্নমানের নকল এলইডি টিভি। এর মধ্যদিয়ে প্রতারকচক্রটি ইতোমধ্যে হাতিয়ে নিয়েছে লাখ লাখ টাকা। উপহারের লোভে কেউ কেউ ৮-১০টি কার্ড সংগ্রহ করে (কিনে) পড়েছেন বিপাকে। সরল-সোজা  নারী-পুরুষ হাজার টাকা স্ক্যাচ কার্ড ঘষে পুরস্কার হিসেবে এলইডি নিতে আসছেন চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অদূরে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিসে। এসেই খাচ্ছেন বড়সড় ধাক্কা। গুনতে হচ্ছে আরও ৬ হাজার ৩৮০ টাকা।

চুয়াডাঙ্গা শহরে গত কিছুদিন স্ক্র্যাচ কার্ড ঘষে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস অফিস থেকে এলইডি টিভি কেনার যে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে তা অনুসন্ধান করে দেখা গেছে এটি বড় ধরনের প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর তা করা হচ্ছে অত্যন্ত কৌশলে। অভিযুক্ত প্রতারকচক্র ঘাঁটি গেড়েছে ঢাকা নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে চুয়াডাঙ্গা শহরের নিয়ন্ত্রণ। যোগাযোগের মাধ্যম মোবাইলফোন। স্ক্র্যাচ কার্ডেই দেয়া আছে ৮টি মোবাইল নম্বর। আর টিভির বাক্স খুললে মিলছে একটি খাম। তাতে কোম্পানির মালিকের নাম লেখা আছে পিয়াল হাসান রুপম। দেয়া আছে দুটি মোবাইল নম্বর ও একটি ওয়েব ঠিকানা। যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে সহজেই মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। মোবাইল নম্বর দুটির মধ্যে একটি চালু আর ওয়েবসাইটটি ভুয়া। খামে যে ঠিকানা দেয়া আছে তার সাথে টিভি বাক্সের ঠিকানার কোনো মিল নেই। স্ক্র্যাচ কার্ডে যে ঠিকানা দেয়া আছে সেটি হলো- পিএইচআর ইলেকট্রনিক্স ও ফার্নিচার মেলা, বিশ্বরোড (গোল চত্বর সংলগ্ন) তারাব পৌরসভা, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ। খামে ছাপানো আছে ৬টি ঠিকানা। কথিত এই হাইহাই এমএলএম কোম্পানি ইংরেজিতে যে স্লোগান লিখেছে তার বাংলা করলে দাঁড়ায় আপনার স্বপ্ন আমাদের লক্ষ্য। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভূইফোঁড় যেসব এমএলএম কোম্পানি গড়ে উঠেছে তাদের প্রতারণার ধরণ ও চুয়াডাঙ্গায় জাল বিস্তার করা পিএইচআর’র কাজের ধরন একই রকম।

সরেজমিনে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে দু দফা চুয়াডাঙ্গা সদর থানার অদূরে রজব আলী মার্কেটে অবস্থিত সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে গিয়ে দেখা গেছে ৬ হাজার ৩৮০ টাকা মূল্যের নকল স্যামসাং ও এলজি টিভি কিনতে আসা মানুষের ভিড়, যাদের অধিকাংশই গ্রামের বাসিন্দা। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেলো কেউ-ই সরাসরি আসেননি। শহরে বা গ্রামের কারো কাছ থেকে ১ হাজার টাকায় কিনেছেন স্ক্র্যাচ কার্ড। আর সে কার্ড ঘষে পাওয়া টিভি নিতে এসেছেন। কিন্তু এখানে এসে বেঁধেছে বিপত্তি। নির্ধারিত টাকা পরিশোধের পর কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ একটি টিভির কার্টুন হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে। যাতে ব্র্যান্ডের নাম লেখা আছে এটিআই অথবা ভিএক্স-৩৩। তবে ওই বাক্স বাড়িতে গিয়ে খুলতে হবে। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিস বাক্সের ভেতর কি আছে সেটির যেমন দায়িত্ব নিচ্ছে না, তেমনি ক্রেতাও ধন্দ্বে পড়ছেন নেবো কি নেবো না। শেষমেশ বেকায়দায় পড়ে গিলতে হচ্ছে নকল টিভি। কুরিয়ার সার্ভিস অফিসের বাইরে নিয়ে এসে কার্টুন খুলে বের করছেন এলজি, স্যামসাং স্টিকার লাগানো কম্পিউটর মনিটর!

এ ব্যাপারে সুন্দরবন চুয়াডাঙ্গা শাখার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, কুরিয়ার সার্ভিসের নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরনের বুকিঙে কি মালামাল কি এলো সেটি দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। ঠিকানা অনুযায়ী গ্রাহক অফিসে এসে তার মালামাল বুঝে নিয়ে যাচ্ছেন। কোনো সামগ্রী নষ্ট বা ভাঙা থাকলে সেটির কি হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা জানালেন সুন্দরবন কুরিয়ার সেক্ষেত্রে শুধু সাক্ষী হবে। এ পর্যন্ত কয়টি টেলিভিশন ডেলিভারি হয়েছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, শ তিনেক হবে। অথচ গতকালই তাদের অফিসে দেখা গেছে অন্তত ৫০টি কথিত এলইডি টিভি এক কোণে পড়ে আছে। বিকেল ৫টা। চুয়াডাঙ্গা শহরের সবুজপাড়ার এক গ্রাহক সুন্দরবন কুরিয়ারের ওই অফিসে তার টেলিভিশন ফেরত নিয়ে এসে অভিযোগ করলেন কার্টুনের গায়ে লেখা আছে ১৯ ইঞ্চি অথচ বাড়ি গিয়ে খুলে দেখি ১৭ ইঞ্চি টেলিভিশন। এখন কি করবো? কুরিয়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ এটিরও কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। কোম্পানিতে যোগাযোগ করুন। ফোন দেয়া হলো কোম্পানির মালিকের সেই মোবাইল নম্বরে। তিনি জানালেন, বাংলাদেশে অন্তত দুইশটি টেলিভিশন কোম্পানি আছে। সবাই নিজের মতো ব্যবসা করছে। আমরা চীন থেকে এই মনিটর (টিভি) আমদানি করে বিক্রি করছি। প্রশ্ন করা হলো- কার্টুনের গায়ে যে নাম লেখা আছে তার সাথে ভেতরে থাকা টিভির নাম মিলছে না কেন? এগুলো কেন নামিদামি কোম্পানির সিল লাগানো? গ্রাহকই আমাদেরকে এসব নামের স্টিকার লাগিয়ে দিতে বলে। এসব বক্তব্য ওই কোম্পানির মালিক দাবিকারী পিয়াল হাসানের। স্ক্র্যাচ কার্ড পদ্ধতিতে টেলিভিশন বিক্রি এবং টেলিভিশন কিনলে কার্টুনের ভেতের আরো ১০টি স্ক্র্যাচ কার্ড সেগুলো প্রত্যেকটি এক হাজার টাকা করে বিক্রি করলে আরো…..আপনারা কি এমএলএম ব্যবসা করছেন? উত্তরে পিয়াল হাসান জানান, ভাই এটি কোনো এমএলএম টেমএলএম নয় আমরা সরাসরি গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছাচ্ছি। তাহলে চুয়াডাঙ্গার ফাতেমা প্লাজা, আলী হোসেন মার্কেটসহ অন্য ইলেকট্রনিক্স দোকানে ওয়ারেন্টি-গ্যারান্টি ছাড়া যে সকল কম্পিউটার মনিটর কাম টিভি ৪ হাজার টাকা মূল্যে বিক্রি হয় তার দাম কেন আপনাদের স্ক্র্যাচ কার্ডসহ ৭ হাজার ৩৮০ টাকা হবে? পিয়ালের উত্তর- আমাদের পণ্যের মান ভালো। মান ভালো হলে ওয়ারেন্টি আছে? লম্বা একটি টান দিয়ে বললেন হ্যাঁ। গ্রাহক এ ওয়ারেন্টি সেবা কিভাবে পাবে? পিএইচআর প্রধান পিয়ালের উত্তর, নষ্ট অথবা সমস্যা হলেই সুন্দরবন কুরিয়ারে আমাদের ঠিকানায় পাঠালে আমরা সমাধান করে দেবো। ধোঁয়াশায় ঘেরা লোভনীয় অফারের ফাঁদে পা দিয়ে যারা এলইডি টিভি ঘরে তুলেছেন তাদের উদ্দেশ্যে শহরের একজন প্রথমসারির টিভি টেকনিশিয়ান সাফ জানিয়ে দিলেন এরা সবাই ঠকেছে। সহজ-সরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে স্থানীয় কয়েকজন দালালকে কাজে লাগিয়ে ভূইফোঁড় প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখনই এদের লাগাম না টেনে ধরলে প্রতারিত হবে বহু মানুষ।

এ ব্যাপারে চুয়াডাঙ্গা ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার বেলায়েত হোসেন জানান, কথিত এমএলএম কোম্পানির টিভি কিনে কেউ যদি মনে করেন প্রতারিত হয়েছেন তাহলে অবশ্যই অভিযোগ দাখিল করুন। পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। প্রসঙ্গত, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয়। এই আইনে ব্যবসার জন্য লাইসেন্স নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। লাইসেন্স দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হলো রেজসকো। সুর্নিদিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, পণ্য বার সেবার অযৌক্তি মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য ও কাপ্লনিক বিভ্রান্তকর তথ্য না দেয়া এ আইনের আওতায় পড়ে। এ আইন অনুযায়ী কোনোটিই মানেনি কথিত নারায়ণগঞ্জের পিএইচআর। অবিলম্বে এদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে স্থানীয় এজেন্টসহ সকলকে নকল পণ্য ও নিম্নমানের পণ্য বিক্রি ও প্রতারণার দায়ে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সচেতনমহল।