ওরা এখন খুন ধর্ষণ অগ্নিসংযোগেই ব্যস্ত
স্টাফ রিপোর্টার: ‘কোথাও আমাদের আশ্রয় নেই। আমাদের কোনো দেশ নেই। তাই ঘরবাড়ি ও পরিবার ছেড়ে প্রাণ রক্ষার জন্য বাংলাদেশে চলে আসতে হলো। কারণ মিয়ানমারে কত রোহিঙ্গা নাগরিককে যে মেরে ফেলা হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। অনেক পরিবারের সদস্যদের খোঁজ মিলছে না।’
কথাগুলো বলছিলেন রোহিঙ্গা নারী মাহমুদা আক্তার। তার বোনের ওপর নৃশংসতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন তিনি। এ সময় তার পাশে থাকা আরেক নারী বলে উঠলেন, মিয়ানমারের সৈন্যরা সন্ত্রাসীদের না ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জবাই করা, আগুনে পুড়িয়ে দেয়া এবং নারীদের ধর্ষণ-নির্যাতনে ব্যস্ত রয়েছে। প্রতিবাদ করলে রেহাই নেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ‘হয় মুখ বুজে তাদের বর্বরতা সহ্য কর, নয়তো প্রাণে মর!’ তিনি বলেন, মিয়ানমারের সেনারা যেদিন যে পাড়ায় খুশি রাতের বেলা ঢুকে পড়ছে। তারা পাড়া ঘিরে কিশোরী তরুণীদের ওপর নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন চালাচ্ছে। স্বর্ণালঙ্কার, টাকা লুটপাট করছে। চলে যাওয়ার সময় ঘরে আগুন দিচ্ছে। প্রাণের ভয়ে এপারে (বাংলাদেশে) এসেও আমরা খেতে পারছি না। এক বেলা খেলে আরেক বেলা না খেয়ে থাকতে হয়। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কিন্তু চিকিত্সার সুযোগ নেই। পৃথিবীতে আমাদের জন্মটাই হয়তো ভুল!
গতকাল শুক্রবার সকালে টেকনাফের লেদা বস্তিতে এক রোহিঙ্গা পরিবারের সাথে কথা হয়। তাদের নির্বাক চাহনি, অভিব্যক্তি, আচরণ বলে দিচ্ছিলো সীমান্তের ওই কাঁটাতারের কাছে কতটা অসহায় তারা। মা-বাবা হারিয়ে, স্বজন পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভালো নেই তারা। তারা গত বুধবারে নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন।
এ সময় দিল মোহাম্মদ জানান, তার গ্রাম ছোট গজরবিল এলাকায়। তার অভিযোগ, মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিপি, সেদেশের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় রাখাইনরা নির্বিচারে তাদের গ্রাম ও আশপাশের গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করছে। পুরুষদের ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করছে, অনেক নারীকে ধর্ষণ করছে, শিশুদেরও হত্যা ও নির্যাতন করছে। এখন যারা এপারে আসছেন শুধু তারা নয়, আগে যারা এসেছেন তারাও এখনো ওখানকার সরকারি বাহিনীর নিপীড়নের কথা ভুলতে পারছেন না। তেমনই একজন মো. রশিদ। এক যুগ আগে মংডু শহরে তার মা-বোনকে ধর্ষণ ও হত্যা করে সেদেশের সেনাবাহিনী। এরপর প্রাণ বাঁচাতে কক্সবাজারের টেকনাফ লেদা ক্যাম্প শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন তিনি। এখনো সেই ভয়াল স্মৃতি মনে এলে আঁতকে ওঠেন তিনি। টেকনাফ লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান ধুধু মিয়া জানান, নির্যাতনের শিকার হয়ে এ ক্যাম্পে কিছু রোহিঙ্গা ঢুকছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের খোঁজখবর নিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।
এদিকে গত ৯ অক্টোবরের পর থেকে বিজিবি নাফ নদীর কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অন্তত ৪০টি নৌকা বোঝাই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশে ঢুকতে বাধা দিয়ে মিয়ানমারের দিকে পাঠিয়েছে। এছাড়া ৩১৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। তাদের খাবার ও মানবিক সহায়তা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। সীমান্তে বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও পুলিশের টহল জোরদার রয়েছে।
টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানান, সীমান্ত জুড়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। নাফ নদীর যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বেশি প্রবেশের চেষ্টা করছে সেসব পয়েন্টে বিজিবির সর্বোচ্চ নজরদারি আছে। ইতিমধ্যে অতিরিক্ত তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে আশ্রয় নেয়া স্বামী হারা রোহিঙ্গা জরিনা খাতুন (৫৫) বলেন, রাতের আঁধারে সেনা সদস্যরা অতর্কিতে তাদের গ্রামে এসে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় অন্ধকারে প্রাণ বাঁচাতে কে কোথায় গেছে তা জানা সম্ভব হয়নি। নূর ফাতেমা (৭), সাহেনা (৬) ও হাসিনা (৫) এই তিন নাতি নিয়ে পার্শ্ববর্তী পাহাড়ি জঙ্গলে আশ্রয় নেন তারা। পরে ঝিম্মংখালী সীমান্ত পথধরে কোনো প্রকারে এপারে চলে আসেন। তিনি বলেন, মোহাম্মদ শাহ আলম (১৭), নূর সালাম (১৫), হামিদ হোছন (১২), আমান উল্লাহসহ (১০) ৪ ছেলে কোথায় গেছে খোঁজ-খবর পায়নি। কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি ঘুরে জানা যায়, ১০ পরিবারের অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। মংন্ডু পোয়াখারী নয়াপাড়া থেকে আসা মোহাম্মদ ইউনুছ (২৫) জানান, তারা রাতে ভাত খাওয়ার সময় সেনাবাহিনীর সদস্যরা গ্রামে ঢুকে গুলি বর্ষণ করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ সময় বাড়ির বাইরে এসে দেখা যায়, সবাই ছুটোছুটি করে পালাচ্ছে। তিনি ও তার স্ত্রী তসলিমা (২২) তাদের দুই সন্তান মোহাম্মদ ইদ্রিস (৪) ও হাবিবাকে (৩) নিয়ে পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেতে লুকিয়ে পড়েন। পরদিন রাতের আঁধারে টেকনাফ উপজেলার নয়াপাড়া ঘাট দিয়ে এদেশে চলে আসেন। তিনি জানান, নাফ নদী পার হওয়ার সময় নৌকা ওয়ালা জনপ্রতি ত্রিশ হাজার (কিয়াত) ভাড়া আদায় করেছে।
উখিয়া-টেকনাফ সীমান্ত থেকে আজহার মাহমুদ জানান, সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে স্থানীয় দালালদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা এদেশে ঢুকছেন। অনেকে উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম সীমান্ত দিয়েও অনুপ্রবেশ করছেন।