মিয়ানমারে ৯ রোহিঙ্গাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা

 

পালিয়ে আসা ১২৫ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে কোস্ট গার্ড

স্টাফ রিপোর্টার: মিয়ানমারে চরম নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গারা। রাখাইন প্রদেশে অন্তত ৯ জন রোহিঙ্গাকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। শুধু মংড়ুর একটি গ্রামে এখন পর্যন্ত ৯০ জন নারী-পুরুষ-শিশু নিখোঁজ রয়েছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান সমর্থিত ‘রোহিঙ্গা ভিশন’ নামে একটি ওয়েবসাইটে পোস্ট করা এক ভিডিওচিত্রে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, আগুনে পোড়া কয়েকটি মরদেহ এবং এগুলোকে ঘিরে তাদের স্বজনরা আর্তনাদ করছে।

এদিকে রাখাইন রাজ্যের কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালাতে মুসলিম বিরোধী একটি মিলিশিয়া গ্রুপকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে এমন খবর প্রচারের পর প্রাণভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। শুক্রবার রাতে নাফ নদী পার হয়ে অবৈধভাবে কক্সবাজারের টেকনাফে প্রবেশের চেষ্টাকালে ১২৫ রোহিঙ্গাকে আটকের পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদস্যরা। আর জাতিসংঘ বর্তমান মানবিক পরিস্থিতিকে ভয়াবহ উল্লেখ করে, রাখাইন রাজ্যে জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ পাঠানোর অনুমতি দিতে বলেছে। অন্যদিকে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অনলাইনে এক আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন হাজার হাজার মানুষ। রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারে কোনো অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।

গত অক্টোবরে এক পুলিশ চেকপোস্টে অতর্কিত হামলায় ৯ পুলিশ নিহতের পর বিদেশি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অভিযোগ তুলে রাখাইন প্রদেশে ব্যাপকভিত্তিক সেনা অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা, মহিলা ও কিশোরীদের ধর্ষণ, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। সেনাবাহিনী বরাবরই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। টানা অভিযোগের এক পর্যায়ে তারা সম্প্রতি শুধু ৬৯ জন রোহিঙ্গা (তাদের ভাষায় বাঙালি) এবং ‘সহিংস হামলাকারী’কে হত্যার কথা স্বীকার করেছে। তবে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে মৃতের সংখ্যা ১৩০ ছাড়িয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর রাখাইন প্রদেশে সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ফলে ওই এলাকার প্রকৃত অবস্থা জানা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ গতকাল বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ভিশন নামের ওয়েবসাইটে পোস্ট করা একটি ভিডিওচিত্রে আগুনে পোড়া মৃতদেহ ঘিরে স্বজনদের আর্তনাদ করতে দেখা গেছে। ভিডিওটিকে নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে এতে যাদেরকে দেখানো হয়েছে তাদের ভাষা অনেকটা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকার আঞ্চলিক ভাষার মতোই। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষকে বিভিন্ন সময়ে এ রকম ভাষাতে কথা বলতে দেখা গেছে। ভিডিওতে রাখাইন প্রদেশের মংড়ুর উত্তরাঞ্চলীয় একটি গ্রামে আগুনে পোড়া ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তিনটি মৃতদেহ দেখানো হয়। আকার দেখে বোঝা যায়, এগুলো মানুষের মৃতদেহ, তবে পরিচয় উদ্ধারের কোনো উপায় নেই। ভিডিওতে একটি মৃতদেহের পাশে বসে দুই মহিলাকে কাঁদতে দেখা যায়। এক মহিলা মৃতদেহটির মুখে হাত বোলাচ্ছিলেন এবং বিলাপ করছিলেন। পাশেই ছিল আরো একটি মৃতদেহ। ভিডিওচিত্রটিতে একজন ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন, সম্ভবত ভিডিওটিও তিনিই ধারণ করছিলেন। তাকে দেখা যায়নি। তিনি বলছিলেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গত ১৩ নভেম্বর এই ঘটনা ঘটিয়েছে। ৯ জনকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। একই সঙ্গে এখনো ওই গ্রামের ৯০ জন নিখোঁজ।

১২৫ রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠিয়েছে কোস্ট গার্ড: সেনাবাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি রাখাইন প্রদেশ কর্তৃপক্ষ মুসলিম বিরোধী মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিচ্ছে বলে খবর প্রকাশের পর রোহিঙ্গাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্যাতনের মুখে পালাতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা।

নাফ নদী অতিক্রম করে অবৈধভাবে কক্সবাজারের টেকনাফে প্রবেশের চেষ্টাকালে শিশুসহ ১২৫ রোহিঙ্গাকে আটকের পর মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড সদস্যরা। শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফ সীমান্তে দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে তাদের আটক করা হয় বলে জানিয়েছেন কোস্ট গার্ড টেকনাফ স্টেশন কমান্ডার লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ নাফিউর রহমান। তিনি জানান, মিয়ানমারের ফাদংচা হয়ে নাফ নদীর সীমান্ত অতিক্রম করে রাতে সাবরাং ইউনিয়নের নয়াপাড়ার সংলগ্ন ৫ নং স্লুইস গেট এলাকায় নৌকা দিয়ে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকালে মিয়ানমারের ১২৫ নাগরিককে আটক করা হয়। তাদের মধ্যে ৩৬ শিশু, ৬১ নারী ও ২৮ পুরুষ রয়েছেন। তারা সবাই মিয়ানমারের ওই এলাকার বাসিন্দা। বৃহস্পতিবার রাতেও ৭৮ জন এবং বুধবার রাতে আরো ১৮ জনকে ফেরত পাঠানো হয়। তিনি আরো জানান, আটক রোহিঙ্গা নাগরিকদের মানবিক সহযোগিতা দিয়ে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাত-দিন নাফ নদীতে টহল চলছে। যদিও মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত খোলা রাখার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য বাংলাদেশ যেন নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে সে সম্পর্কে বলেছে সংস্থাটি।

তবে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। দেশটির সুপরিচিত ইংরেজি দৈনিক নিউ লাইট অব মিয়ানমারের খবরে স্টেট কাউন্সেলর অফিসের নিউজ ইনফরমেশন কমিটির বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে যে শত শত মানুষ নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে বলে খবর বের হচ্ছে, তদন্ত করে সেই খবরের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা মিয়ানমারকে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ: রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন ও ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মিয়ানমারকে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র আদ্রিয়ান এডওয়ার্ডস শুক্রবার জেনেভায় বলেছেন, রাখাইনে জরুরি ভিত্তিতে খাবার, আশ্রয়, ওষুধ ও চিকিত্সা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ৪৩০টি বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে। অনেকে জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন। রাখাইন মিয়ানমারের দারিদ্র্যপীড়িত প্রদেশ এবং সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নিপীড়নের জন্য পরিচিত। এর আগে ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে স্থানীয় বৌদ্ধ ও মুসলিম রোহিঙ্গাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে কমপক্ষে ২০০ জন নিহত হয়।