দুর্নীতি আর অনিয়মই জাতীয়করণের অন্তরায় আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ

 

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের অভ্যন্তরে দুর্নীতি-অনিয়মের ইয়ত্তা নেই। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে যেমনি লাখ লাখ টাকার অর্থ বাণিজ্য করা হয়েছে। তেমনি নিয়োগ দেয়া হয়েছে কলেজ অধ্যক্ষের আত্মীয়-স্বজন ও জামায়াত বিএনপির অনেককেই। কলেজটি জাতীয়করণের জন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে অবৈধভাবে আদায় করা হয়েছে হাফ কোটি টাকার ওপরে। এক শিক্ষক দেশের বাইরে থাকলেও তার নামে তোলা হয়েছে মাসের পর মাস সরকারি বেতন। কলেজের আরেক শিক্ষক অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সব দুর্নীতি-অনিয়মের মূলে রয়েছেন অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম। কলেজটি জাতীয়করণের সম্ভাব্য তালিকায় থাকলেও দুর্নীতি আর অনিয়মই তার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে শিক্ষকদের অভিযোগ। ফলে শিক্ষক-কর্মচারীরা এখন ফুঁসছেন।

জানা গেছে, আলমডাঙ্গা উপজেলার সবচেয়ে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজ। কলেজটি ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে এখানে ১০৭ জন শিক্ষক-কর্মচারীর সমন্বয়ে দেড় হাজারেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়ন করছেন। কিন্তু এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি আর অনিয়মে বাসা বেঁধেছে। শিক্ষক নিয়োগে যেমন বাণিজ্য করা হয়েছে। তেমনি নিয়োগ দেয়া হয়েছে অধ্যক্ষের আত্মীয়স্বজন ও জামায়াত বিএনপির লোকজন। অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ১৯৮৩ সালে প্রভাষক পদে যোগদান করলেও ২০০৭ সালের ১৪ জুন অবৈধভাবে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পান। সে সময় আদালত কর্তৃক আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকা সত্ত্বেও আলমডাঙ্গা পৌর বিএনপির ৩ নং ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। অভিযোগ আছে তিনি ওই সময় কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ফলে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এবং পরিচালনা পর্ষদের কতিপয় বিএনপি দলীয় সদস্যের সহযোগিতায় দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান।

সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ২৪ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজসহ ২২টি কলেজ সরকারিকরণের বিষয়ে পরিদর্শনপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য মাউশি চিঠি দেয়। এছাড়া যেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিকরণের যৌক্তিকতা যাচাইয়ের জন্য পরিদর্শন প্রক্রিয়ায় রয়েছে সেসকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় ওই বছরের ১৬ জুন। কিন্তু সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম অনিয়মতান্ত্রিকভাবে কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ম্যানেজ করে এ পর্যন্ত ৩৩ শিক্ষক ও ৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দেন। নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতি শিক্ষকের কাছ থেকে ৮ থেকে ১০ লাখ এবং প্রতি কর্মচারীর নিকট থেকে তিনি ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা করে উৎকোচ গ্রহণ করেন বলে জানা যায়।

নিয়োগপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রভাষক সোহেল রানা অধ্যক্ষের ছোট জামাই, প্রধান সহকারী সহিদুল ইসলাম ভাতিজা, অফিস সহকারী খালিদ হোসেন  ফুফাতো ভাই ও অফিস সহায়ক শাহজাহান আলী চাচাতো ভাই। এ চারজনই জামায়াত সমর্থক বলে অভিযোগ রয়েছে। কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রভাষক মাহবুব আলম একই সাথে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। গত ৪ বছর যাবত চুয়াডাঙ্গাস্থ ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অভিযোগ রয়েছে, এ সময় তিনি আলমডাঙ্গা ডিগ্রি কলেজের ক্লাস নেননি। কিন্তু অধ্যক্ষের সাথে যোগসাজশে দুই প্রতিষ্ঠানেরই বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন।

এছাড়া দর্শন বিভাগের প্রভাষক আবদুর রাজ্জাক বর্তমানে সুইডেনে অবস্থান করছেন। তিনি এক বছরের ছুটি নিয়ে ২০০৭ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সুইডেনে যান। কিন্তু দু বছর অতিবাস করে ২০১০ সালের ৩ অক্টোবর দেশে ফেরেন এবং অধ্যক্ষকে ম্যানেজ করে ৩ বছরের বকেয়া বেতনভাতা উত্তোলন করেন। পরবর্তী ২০১৩ সালের ২৬ মার্চ সুইডেনে যেয়ে এক বছর পর ২০১৪ সালের ২ মার্চ ফিরে আসেন। পরে মাত্র ২৪ দিন পর ২৬ মার্চ পুনরায় সুইডেনে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। কিন্তু সুইডেন গমনের এক বছর পরও ২০১৫ সালের মে, জুন ও জুলাই মাসের হাজিরা খাতায় তার স্বাক্ষর দেখা যায়। অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম ওই শিক্ষকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করে নিজের কাছে রেখে বেতন ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন বলে জানা যায়। কলেজটি জাতীয়করণের সম্ভাব্যতা যাচাই বাছাইয়ের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের আগস্ট মাসে অডিটদল আসে। সেখানে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর থাকলেও শিক্ষক আবদুর রাজ্জাককে অডিটটিমের সামনে হাজির করতে ব্যর্থ হন অধ্যক্ষ। আবদুর রাজ্জাক গুরুতর অসুস্থ বলে জানানো হয়। তাছাড়া অডিট টিম দেখতে পায় নীতিমালা উপেক্ষা করে সেখানে অতিরিক্ত শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এসব অনিয়ম দুর্নীতির কারণই কলেজটি জাতীয়করণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় বলে শিক্ষক-কর্মচারীরা মনে করছেন। অভিযোগ রয়েছে, কলেজ সরকারিকরণের লক্ষ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ৫০-৫৫ লাখ টাকা চাঁদা উত্তোলন করা হয়। পরবর্তীতে কলেজটি সরকারিকরণ না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের দেয়া টাকা অধ্যক্ষ কর্তৃক আত্মসাতের অভিযোগ তুলছেন।

অন্য আরেক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষক মাহবুব আলমের কাছে বার বার কল করা হয়, এমনকি এসএমএস দিয়ে অনুরোধ জানানো হয় কল রিসিভ করার জন্য তা সত্ত্বেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ফলে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। আদালত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তার অধ্যক্ষ পদে নিয়োগের বিষয়ে বলেন, বিষয়টি নিয়ে শেষমেশ আদালত থেকেই আমার পক্ষে রায় পেয়েছি। প্রভাষক মাহবুব আলমের দুই প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কলেজের গভর্নিং বডিকে জানিয়েছি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য। আর সুইডেন প্রবাসী শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের বিষয়ে অধ্যক্ষ জানান, আবদুর রাজ্জাক আর চাকরি করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ফলে তার অব্যাহতি দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।