খেজুর গাছ কাটার ধুম ব্যস্ত সময় পার করছেন চুয়াডাঙ্গার গাছিরা

 

আলম আশরাফ/রহমান রনজু: প্রকৃতির দুয়ারে হাজির হেমন্ত। কার্তিকের দিনেই শরতের শাদা মেঘের ভেলা উড়িয়ে প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন রূপ। শিশির স্নাত শুভ্র শিউলির ঘ্রাণের সাথে মৃদু শীতের ছোঁয়া নিয়েই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ফসলের ক্ষেত দানা বাঁধবে নতুন ধান। বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, গাছিরা কোমরে দড়ি বেধে খেজুর গাছের চেহারা ফেরাচ্ছেন। এতেই বোঝা যাচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা।

শীত মরসুমের প্রায় ৫ মাসব্যাপি এই রস সংগ্রহ উৎসব চলবে। বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদের ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরের এ সময়ে খেজুর রসের কদর বেড়ে যায়। কারণ খেজুর রসের সুমিষ্ট রসের স্বাদ ও ঘ্রাণ একেবারেই আলাদা।পুরো শীত মরসুমব্যাপি চলে এর পিঠা পুলি আর পায়েস খাওয়ার পালা।

দিগড়ি গ্রামে গাছি মজনুর রহমান জানান, এবার একটু আগেভাগেই খেজুর গাছ কাটতে শুরু করেছেন এবং কয়েক দিনের মধ্যেই রস সংগ্রহের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হবে। এ বছর আগে ভাগেই শীতের আমেজ শুরু হওয়ায় গাছিদের জন্য অবশ্যই ভালো হয়েছে। জেলায় এখন পর্যন্ত শীত তেমন জেঁকে না বসলেও গাছিরা দা তৈরি, দড়ি ও মাটির ভার কেনা, রস জাল দেয়ার স্থান ঠিক করাসহ যাবতীয় কাজ পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন, তারা পার করছেন ব্যস্ত সময়। এখানকার খেজুরের গুড়, পাটালি দেশের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

সরেজমিন জানা যায়, খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য গাছিরা কর্মতৎপরতার মধ্যদিয়ে দিন পার করছেন। গাছিরা তৃপ্তিকর সুমিষ্ট খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ তোলা বা চাচ দেয়াসহ সব কার্যক্রম শেষ করার জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। গাছিরা হাতে দা নিয়ে, কোমরে দড়া (মোটা দড়ি) বেঁধে নিপুণ হাতে গাছ চাছা-ছোলা এবং নল দিয়ে গাছে ভাড়ে বেধে রস সংগ্রহের জন্য কাজ করছেন। মৃদু শীত অনুভূত এবং সামনে বেশি শীতের সময় অধিক রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ কাটার ধুম পড়েছে বলে একাধিক ব্যক্তি জানান। শীত মরসুম এলেই সর্বত্র শীতে নতুন আয়োজন শুরু হয়। খেজুরের গাছ থেকে রস সংগ্রহ, গুড় ও পাটালি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন এ অঞ্চলের গাছিরা। পাশাপাশি খেজুর গাছ মালিকরা গাছিদের টাকা দিয়ে গাছ থেকে রস সংগ্রহের যাবতীয় কাজ করে নেয় অথবা গাছিদের কাছে তাদের গাছ ভাগে দিয়ে দেয়। শীত মরসুমে সকলের মুখে ভেসে ওঠে রসালো হাসি। এখানে শীতের দিন মানেই গ্রামাঞ্চলে খেজুরের রস, নতুন পাটালি ও গুড়ের মৌ মৌ গন্ধ। শীতের সময় ভোরে এবং সন্ধ্যায় খেজুরের রস যে কতোটা তৃপ্তিকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শীত সকালে রসের পায়েস এবং পিঠা অত্যান্ত মজাদার। সে কারণে শীতের সময় প্রতিদিন কারো না কারো বাড়িতেই খেজুর রস দিয়ে তৈরি কিছু খাদ্যের আয়োজনতো থাকবেই। এ সময়টা খেজুরের রস, গুড়, পাটালি ছাড়া শীতকালীন উৎসব ভাবাই যায় না। শীতের সকালে অনেক যুবক দল বেধে গাছ থেকে রস খেতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও খেজুরের রস জ্বাল দেয়া হয়, বাতাসে খেজুরের রসের মিষ্টি গন্ধ আশপাশের সকলকে মোহিত করে। শীতের সকালের কুয়াশা আশপাশে ভরে থাকে, সূর্যের ঝলকানিতে তা বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঢাকা আবরণ খুলে যায়। শীতের সকালে রসালো গ্রাগুলোর আসল রূপ। শীতের সকালে রূপমাধুরী উপভোগ করতে মানুষ শহর থেকে গ্রামে আসে সমস্ত কিছু উজার করে উপভোগ করে দুর্বা ঘাসের ওপর থাকা শিশির বিন্দু বিন্দু কনা আর খেজুরের রসের মৌ মৌ গন্ধ সকলকে এক প্রকার মোহিত করে।

আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ি গ্রামের আব্দুল গনি, আইলহাস গ্রামের উচমান বারো ঘরিয়ার সারজুলসহ একাধিক গাছি এবং খেজুর গাছমালিক বলেন, একটি গাছ কাটা দা কিনতে ৩৫০-৪০০ টাকা লাগে। এক সময় এখানে অনেক খেজুর গাছ ছিলো। তা থেকে প্রচুর রসও পাওয়া যেতো। এলাকায় ইটভাটায় প্রচুর খেজুর গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার কারণে গাছ অনেক কমে যাচ্ছে। একটি গাছ তোলা থেকে প্রথম রস সংগ্রহ করা পর্যন্ত ৫০-৬০ টাকা গাছ মালিকরা গাছিদের দিয়ে থাকেন। পরবর্তীতে সপ্তাহে ১ দিন গাছপ্রতি ৮-১০ টাকা দিয়ে থাকেন। পাশাপাশি রস থেকে গুড়, পাটালি তৈরি জ্বালানি দামও বেড়ে গেছে। আগের মতো এখন আর খেজুর গাছ এলাকায় দেখা যায় না। প্রতিদিন ইটভাটায় কাঠ ব্যবহারের কারণে নিধন হচ্ছে শ শ খেজুর গাছ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে দারুণভাবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গাছিরা দিন দিন রস সংগ্রহের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন বলে তারা জানান।

সার্বিক দিক বিবেচনা করে শুধুমাত্র রস, গুড়, পাটালিসহ সুস্বাদু খাবার তৈরির জন্য নয়। আমাদের সবার জীবনে অতি প্রয়োজনে পাশাপাশি পরিবেশ এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে এসে খেজুর গাছকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে এমনই ধারণা করছেন গাছি, গাছমালিকসহ সর্বমহল।

এছাড়া খেজুরের রস দিয়ে পাটালি গুড়, চিনি, ব্রাউন সুগারসহ নানা মিষ্টান্ন দ্রব্যাদি তৈরি করা যায়। আর শীতের সকালবেলায় খেজুরের সুমিষ্ট রস খেতে ভারি মজা। উপজেলার গ্রামাঞ্চলে রাস্তার দু পাশে এবং অনেক বাড়িতেই খেজুরের গাছ রয়েছে। সারাবছর এ গাছগুলো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে থাকলেও শীত মরসুমে এর কদর বেড়ে যায়। এ গাছগুলোকে অবলম্বন করেই অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। তাই এখানকার গ্রামাঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই খেজুর রসের সাথে সংশ্লিষ্ট সবাই এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।