গাংনী হাসপাতালে ডাক্তারের পদ রয়েছে পর্যাপ্ত : নেই শুধুই ডাক্তার!

 

মাজেদুল হক মানিক: একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা, ১০ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, মেডিকেল অফিসার ৬ জন এবং উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার (স্যাকমো) ডজনখানেক রয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ের একটি হাসপাতালে এর চেয়ে আর কি বেশি ডাক্তার লাগে? এতেই তো গরিব-দুস্থ মানুষের ভালো মানের চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথা। নিজ এলাকাতেই যখন নাক-কান-গলা, শিশু, গাইনি, অর্থোপেডিক্স, মেডিসিনসহ প্রায় সব ধরনের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সেবা পাওয়া যায় তাহলে তো আর কুষ্টিয়া কিংবা ঢাকায় দৌড়াতে হবে না। খরচ করতে হবে না কাড়ি কাড়ি টাকা। কিন্তু বাস্তবে যদি এসব ডাক্তারের পদগুলো পূরণ থাকত তাহলে স্বপ্নপূরণ হতো সব শ্রেণি পেশার মানুষের। এমনটিই জানালেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মকর্তা।

হ্যাঁ ওপরের ডাক্তারের পদগুলো আসলে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স তথা গাংনী হাসপাতালে ডাক্তারদের মঞ্জুরিকৃত পদ। তবে পর্যাপ্ত পদ থাকলেও পদে নেই ডাক্তার। উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকতা, ৩ জন মেডিকেল অফিসার ও কয়েকজন স্যাকমো ছাড়া বাকি পদগুলোর সবই ফাঁকা। অনেকটা নামে তাল পুকুর, অথচ ঘটি ডোবে না প্রবাদ বাক্যের মতই অবস্থা।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত হলে বাড়ে ডাক্তারদের পদ। সেমতে জুনিয়র কনসালটেন্ট অর্থাৎ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের পদ দাঁড়ায় দশে। কিন্তু বছর চারেক আগে তিনজন কনসালটেন্ট থাকলেও বর্তমানে একজনও নেই। কানসালটেন্ট (ইএনটি) পদে খালেদ শাহরিয়ার নামে একজন বেশ কিছুদিন এখানে দায়িত্ব পালন করার পর মন বসেনি। অদৃশ্য শক্তির বলে তিনি মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ডেপুটেশনে যান। পরে সেখানেই বদলি নিয়েছেন। এর আগে গাইনি কনসালটেন্ট ডা. আলাউদ্দীন বিভিন্ন নাটকীয় পরিস্থিতি তৈরি করে বদলি হন। তার বিরুদ্ধে অবশ্য অনেক অভিযোগ ছিলো। এভাবে কনসালটেন্ট পদে বেশ কয়েকজন পোস্টিং পেলেও এখানে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেননি। এর পেছনে হাসপাতালের জরাজীর্ণ ভবন, ডাক্তারদের ওপর হামলা, তুচ্ছ ঘটনায় ডাক্তার লাঞ্ছিত ও অদৃশ্য আরও কিছু অসুবিধা বিবেচনায় প্রত্যেক ডাক্তার ঊর্ধ্বতন মহলে তদবির করে বদলি হয়েছেন বলে হাসপাতালের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।

হাসপাতালের প্রাণ হিসেবে পরিচিত মেডিকেল অফিসার পদ। যারা ইনডোর ও আউটডোরে পর্যায়ক্রমে চব্বিশ ঘণ্টা ডিউটি করে থাকেন। সেই মেডিকেল অফিসারের ৬টি পদে মাত্র তিনজন রয়েছেন। এর মধ্যে ডা. এমকে রেজা চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব সারছেন। অপর দুজনের মধ্যে ডা. সেলিম উদ্দীনের মূল পোস্টিং মটমুড়া ইউনিয়ন তথা মহাম্মদপুর সাব সেন্টারে। এসব বাড়তি দায়িত্ব মাথায় নিয়ে অসংখ্য রোগীর চাপে ৩ জন মেডিকেল অফিসারের নাভিশ্বাস উঠছে। জরুরিভাবে আসা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা বা ব্যান্ডেজ করে রেফার করা ছাড়া যেন আর কোনো কিছুই করার নেই। কিছুদিন আগে পোস্টিং পাওয়া ডা. সুমাইয়া ও রফিকুন্নবী খুঁটির জোরে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ডেপুটেশনে চলে যান। পরে সেখানেই বদলি ওর্ডার করে থেকে গেছেন। গাংনী হাসপাতালে আর ফিরে আসেননি। গাংনী হাসপাতালে ডাক্তারে অভাব থাকা অবস্থায় কিভাবে তারা ডেপুটেশনে মেহেরপুর হাসপাতালে গেলেন সে প্রশ্নের সদুত্তোর মেলেনি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে সরকারি হাসপাতালে সেবা নেয়ার হার সবচেয়ে বেশি মেহেরপুর জেলায়। তাই প্রতিদিনই জেলার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। অপরদিকে মারামারি, সড়ক দুর্ঘটনা ও জরুরি প্রয়োজনে চিকিৎসা নিতে আসলে রোগীরা পড়েন চরম বিপাকে। পদ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র জনবল সঙ্কটের কারণে রোগীদের কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ঢাকা মেডিকেলে রেফার করা হয়। এতে রোগীদের সেবার বদলে বাড়তি দুভোর্গ পোয়াতে হয় বলে জানান রোগীর স্বজনরা।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্ট মাসে এ হাসপাতালে আউটডোরে প্রতিদিন গড়ে ৫৫৬ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। যার মধ্যে গত ১৩ আগস্ট ওই মাসে সর্বোচ্চ ৮১৫ জন চিকিৎসা নেন। ইনডোরের অবস্থাও খুবই নাজুক। গত প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৩ জন রোগী ভর্তি ছিলো। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ভর্তি ছিলো ৬৫ জন। এসব তথ্য থেকে সহজেই বোঝা যায় গাংনীর মানুষ হাসপাতালের চিকিৎসার ওপর কতোটা নির্ভরশীল। হাসপাতালের একটি সূত্রে জানা গেছে, ৫০ শয্যায় উন্নীত হাসপাতালটির প্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। নির্মাণ শেষ হলে ডাক্তারদের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত হলে হয়তো শুন্য পদে ডাক্তার আসতে পারেন।

এলাকার যারা ডাক্তার হয়েছেন তাদেরকে এলাকার মানুষের সেবা দেয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা ডা. অপূর্ব কুমার সাহা বলেন, স্থানীয় যারা অন্য জেলায় কর্মরত আছেন তাদেরকে নিজ জেলার মানুষের সেবার কথা বিবেচনা রাখতে হবে। অন্যদিকে হাসপাতালের সীমাবদ্ধতা ও রোগীর শারীরিক বাস্তবতার কথা চিন্তা করে স্থানীয় মানুষ ও রোগীর স্বজনদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে কাউকে অযথা দোষারোপ না করে বাস্তবতা মেনে নেয়ার মানসিকতা পোষণ করতে হবে। হাসপাতালে কর্মরতদের জন্য অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত না করতে পারলে ডাক্তাররা শুধুই যাওয়া-আসা নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। পদ পূরণ হবে না। ডাক্তারের ফাঁকা চেয়ারের বিষয়ে তিনি নিজের চেষ্টার বিবরণ দিয়ে অনেকটাই অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন।