অন্ধকারে দেখা চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল

 

উজ্জ্বল মাসুদ/রহমান রনজু: কখন যে কার কী অবস্থায় কোন হাসপাতালে ছুটতে হয় তা কে জানে? আগাম বলা কঠিন। তবে জেলা সদর হাসপাতাল জেলাবাসীর প্রাথমিক আস্থারই প্রতীক। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটি কতটুকু আস্থার?  উন্নয়ন, লোকবল সঙ্কট কাটাতে পারা না পারাসহ স্বাস্থ্য সেবার মান নিয়ে বিতর্ক আছে বিস্তর। অভিযোগেরও অন্ত নেই। অতোসবের মাঝে রাতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল কেমন থাকে? তা দেখতেই মাথাভাঙ্গার দুজন কলম সৈনিক গতরাতে দীর্ঘ সময় অবস্থান নেন হাসপাতালে। দুর্ভাগ্য! যেদিন রাতের হাসপাতাল দেখার দায়িত্ব, সেদিনই চুয়াডাঙ্গায় প্রবল বর্ষণে বিদ্যুতের করুণ দৃশ্য।

অন্ধকারে হাসপাতালের রোগী ও রোগীর লোকজনের যে কতোটা দুর্ভোগে তা দূরে বসে অনুমান করাও অসম্ভব। সঙ্গত প্রশ্ন, অতো দামি সেই সরকারি ডায়নামা চলেনা? চলে। গতকালও চলেছে। দুপুর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চালিয়ে বন্ধ করে দেন কর্তব্যরত রনি। তিনি বললেন ডায়নামা সরকারি হলেও তেল দেন হুইপ ছেলুন জোয়ার্দ্দার এমপি। বিদ্যুত আসে রাত সোয়া ১টার দিকে। বিদ্যুত না থাকা মুহূর্তগুলো কতোটা ভুরকুষ্টে ছিলো বোদ্ধারা চোখ বুঝলেই বুঝবেন।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালটির ক্রম উন্নয়নে গতি থিতু না হলেও দীর্ঘদিনে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক পদ পুনঃচালু করা যায়নি। একনেক কমিটির একটি দল সরেজমিন তদন্ত করে অজ্ঞাত কারণে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মেডিকেল অফিসার পদ বিলুপ্তির সুপারিশ করে। তাতে সাড়া দেয় একনেক। এরপর? আর ওই পদ দেয়া হয়নি। তা হলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগ তথা ইমারজেন্সি বিভাগ চলে কীভাবে? হাসপাতালের মেডিকেল অফিসারদের পালাক্রমে দায়িত্ব বণ্ঠনের মাধ্যমে। এ দায়িত্ব বণ্ঠন করতে গিয়ে কখনো কখনো আবাসিক মেডেকেল অফিসারকেও নিতে হয় জরুরি বিভাগের দায়িত্ব। গতরাত সাড়ে ১১টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের হালচিত্র নিতে গেলে জরুরি বিভাগে পাওয়া যায় ডা. আওলিয়ার রহমান। রোগী না থাকার কারণে তিনি ভেতরেই ছিলেন। ব্রাদার সফিউদ্দীন ও স্বেচ্চাসেবক সজলকে জরুরি বিভাগে বসে থাকতে দেখা গেছে। অবশ্য অন্যদিন জরুরি বিভাগে স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা থাকে কয়েকজনক। গতরাতে বৃষ্টির কারণে তাদের অধিকাংশই বোধ হয় বাড়ির বিছানায় আয়েশ করেছেন।

দেশের সকল মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ অধিকার দয়া নয়। সাংবিধানিক অধিকার। সরকার চিকিৎসা দিতে বাধ্য। এই বাধ্যবাধকতা বাস্তবায়ন হচ্ছে কতটুকু? খাতা কলমে শতভাগ না হলেও নিরানব্বই দশমিক নয়ভাগ। অথচ প্রাপ্য চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কা নিয়ে দিনে রাতে হাসপাতাল ছেড়ে বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রে ছুটছেন অনেকে। না, গতরাতে যখন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে অবস্থান করি আমরা দুজন সংবাদিক, তখন এরকম রোগীর দেখা না মিললেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাইনি কনসালটেন্ট হাসপাতালের ধারের কাছে থাকেন না। অপরজন হাসপাতালের কাছাকাছি বসবাস করলেও সম্প্রতি মহাপরিচালকের নিকট তার চাকরি ন্যস্ত করা হয়েছে। সার্জারী কনসালটেন্ট থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের অনেকেই নিয়ম মানেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। রাতের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল নিয়ে প্রতিবেদন প্রসঙ্গ শুনেই হাসপাতাল এলাকার দোকানি এসব অনিয়ম নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বললেন, ‘অবশ্যই সকল চিকিৎসক সমান নন। কেউ কেউ হাসপাতালে হাজিরা দিয়ে অর্থবাণিজ্যে বাইরের দিকে ঝুকে পড়েন, কেউ কেউ যতো যাই হোক হাসপাতালের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেই বাইরের চলে যান। কারো কারো তো মানবিক দায়িত্বে পকেট থেকে টাকা দিয়ে রোগীর ওষুধ কিনে দিতেও দেখা যায়।’ বৃষ্টিভেজা রাতে ওষুধের দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর একজন বললেন, ঠিকই বলেছেন। সকল মানুষ সমান নয়। তবে সকলের মধ্যে মানবতাটা যদি প্রাধান্য পেতো, দেশটাই বদলে যেতো।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে পয়নিষ্কাষণ ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই ত্রুটিপুর্ণ। ফলে দুগন্ধটা বিকট। বারান্দাগুলো রোগী, বহিরাগত লোকজন সকলে মিলেই যেন নোংরা করি। গতরাতেও নোংরায় কমতি ছিলো না। শিশু ওয়ার্ডে ভিড় ছিলো। এ ওয়ার্ডে সব সময়ই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি রোগী থাকে। অথচ চুয়াডাঙ্গায় শিশু হাসপাতাল নেই। রাত ১২টার দিকে পুরুষ মেডিসিন ও মহিলা মেডিসিন বিভাগের সেবিকাকক্ষে শিক্ষানবিস সেবিকাদের দেখা গেলেও স্টাফ নার্স না পেয়ে কোথায় জানতে চাওয়া হলে বলা হয়, সিস্টার রেস্টে আছেন। মহিলা মেডিসিন ওয়ার্ডের দৃশ্য খানেকটা ভ্রুকুচকানো। কেননা, এ ওয়ার্ডে মহিলা রোগীদের মাঝে পুরুষদের প্রায় সকলেই যেভাবে শুয়ে আছেন তা দেখে পুরুষ হয়েও লজ্জা পেতে হলো।

ঠাণ্ডা শীতল আবহাওয়ার কারণেই বোধ হয় হাসপাতালে রোগীর চাপ কম। গাইনি ওয়ার্ডে মাঝে মাঝে মধ্যরাতে যে করুণ চিত্র ফুটে ওঠে, গতরাতে তেমন কোনো প্রসূতিকে সেভাবে অনিশ্চয়তার প্রহর গুণতে অবশ্য দেখা যায়নি। আর ট্রলি সিঁড়ির ঘোর অন্ধকারের দিকে যেতেই অবশ্য কয়েকজন বারণ করলেন। বললেন ওদিকে যেয়েন না, ঝামেলা হতে পারে। কেন? অতোসতো বলতে পারবো না, গেলে যান, দেখেন কেউ বসে আছে কি-না! না, গতরাতে যে ওই সিঁড়িতে তেমন কাওকে দেখা যায়নি। অথচ রাতে নাকি ওই সিঁড়ির ভেতরে আপত্তিকর কিছু হয় বলে দীর্ঘদিন ধরেই গুঞ্জন রয়েছে। অপারেশন সামনে অন্ধকার। লাশ রাখা ঘর ছিলো শূন্য।

রাত সোয়া ১টার দিকে হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার সময় চোখে পড়লো মধ্যবয়সী এক নারী পানির পাত্র হাতে নিয়ে ছুটছেন বাইরের দিকে। কেন? হাসপাতালে পানীয় পানি নেই। জরুরি বিভাগের সামনের টিউবওয়েলটি সম্প্রতি চালু করা হলেও সেদিকে না হেটে নারী হাটলেন সার্বক্ষণিক খোলা ওষুধের দোকান আভা ফার্মেসির দিকে। সেখান থেকেই নিলেন তিনি পানীয় পানি।

হাসপাতালের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে। নির্মাণাধীন ভবনের ভেতরে মাঝে মাঝেই রাতে মুরগী হাস রান্না করে আসর বসায় কয়েকজন। গতরাতে তেমন আসরের যেমন আঁচ পাওয়া যায়নি, তেমনই হাসপাতাল কম্পাউন্ডেই চিহ্নিত মদ বিক্রেতা জয়নালকেও প্রকাশ্যে পাওয়া যায়নি। তার খোদ্দেরও চোখে পড়েনি।

রাতের হাসপাতাল দেখে রাত সোয়া ১টার দিক যখন প্রস্থান পর্ব, তখন জুতো খুলে হাতে নেয়ার পাশাপাশি প্যান্টটাও গুটিয়ে নিতে হলো। কেননা, বৃষ্টিতে হাসপতালের সামনে জমেছে পানি। ওই পানি মাড়িয়ে মাথাভাঙ্গা দফতরে ফিরতে হলো পায়ে হেঁটে। এ সময় দু জনের মধ্যে আলাপচারিতায় উঠে এলো হাসপাতালে মাদকসেবী চোরচক্রের উৎপাত প্রসঙ্গ। না, গতরাতে তেমন কাউকে হাসপাতালে দেখা যায়নি। ওরা হয়তো অন্য কোথাও, নয়তো শীতল রাত পেয়ে ঘুমিয়েছে বেঘোরে।