সুন্দরবন ঘিরে ১৫০ শিল্প প্রকল্প!

স্টাপ রিপোর্টার: বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এর চারপাশ ঘিরে ভারী শিল্প স্থাপনের জন্য জমি কেনার হিড়িক পড়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩শ শিল্পগোষ্ঠী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি আশপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় ১০ হাজার একর জমি কিনেছেন। জমি কেনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের মধ্যে সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, শিল্পগোষ্ঠী ও সরকারি দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা রয়েছেন।
সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) হিসেবে ঘোষণা করা হলেও পরিবেশ অধিদফতর এই এলাকাতেই ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে। ইসিএ ঘোষণার পর ছাড়পত্র বাতিল করার বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির পক্ষে উপসচিব আবু ফজল মো. রফিকউদ্দিন ইসিএ ঘোষণা করা গেজেটে সই করেন। এতে বলা হয়, ইসিএ এলাকায় ভূমি এবং পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট ও পরিবর্তন হবে এমন কোনো কাজ করা যাবে না। মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণকারী শিল্প বা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না। এর আগে বন বিভাগ থেকে সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে সুন্দরবনের বর্ধিত অংশ বা প্রভাবিত প্রতিবেশ ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। ওই এলাকায় সুন্দরবনের বাঘ, হরিণ, ডলফিনসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর বিচরণ হয়ে থাকে এবং ওই এলাকাকে বন্য প্রাণীর জন্য নিরুপদ্রব এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিলো। পরিবেশ অধিদফতর যে ১৫০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পকে অবস্থানগত ছাড়পত্র দিয়েছে তার সবগুলো ওই ১০ কিলোমিটার বা ইসিএ এলাকার মধ্যে অবস্থিত। তবে ছাড়পত্রগুলো দেওয়া হয়েছিল এলাকাটিকে ইসিএ ঘোষণার আগে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কোনো এলাকাকে ইসিএ ঘোষণা করা হলে সেখানে আর কোনো ধরনের শিল্পকারখানা থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সুন্দরবনের পাশে যারা জমি কিনে শিল্পকারখানা স্থাপনের জন্য অনুমোদন পেয়েছে, তাদের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে নয়, সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। কেননা, দেশের জন্য সুন্দরবনও দরকার আবার শিল্পও দরকার। আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’
শুধু এই ১৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পই নয়, আরও প্রায় ১৫০টি শিল্পগোষ্ঠী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি সুন্দরবন লাগোয়া ওই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে জমি কিনেছেন। বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের সদর থেকে জয়মনিরগোল গ্রাম, রামপাল উপজেলার বিদ্যারবাহন, দ্বিগরাজ থেকে রামপাল সদর পর্যন্ত বেশির ভাগ কৃষি ও জলাভূমি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো কিনে নিয়েছে। সম্প্রতি খুলনা জেলার দাকোপ, কয়রা ও পাইকগাছা উপজেলাতেও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা জমি কেনা শুরু করেছেন। পরিবেশ অধিদফতরের অবস্থানগত ছাড়পত্র পেয়েছে আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, তার ভায়রা কাজী হাসান শরীফ, মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলির ভাই তোহা ইসলাম ও বাগেরহাট জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ সালামের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। সালাম সেখানে পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন বলে জানিয়েছেন। বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে রয়েছে এস আলম গ্রুপ, ইনডেক্স গ্রুপ। তবে ছাড়পত্র পায়নি কিন্তু ওই ১০ কিলোমিটারের মধ্যে জমি কিনেছে মীর গ্রুপ, লিথি গ্রুপসহ আরও ১৫০টি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি।

জমি কেনার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘আমরা ওই জমিতে বেশ কিছু শিল্পপ্রতিষ্ঠান করার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু বিনিয়োগ না পাওয়ায় তা আর করা হয়নি। ফলে আপাতত আমি ওই জমিতে কিছু করছি না।’ বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের অবশ্যই ক্ষতি হবে। তবে তার চেয়েও বড় ক্ষতি হবে যদি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কেনা জমিগুলোতে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে। সরকার যেভাবে সুন্দরবন-সংলগ্ন ওই এলাকায় রেললাইন সম্প্রসারণ, বিমানবন্দর নির্মাণ ও সড়ক যোগাযোগ বাড়াচ্ছে তাতে জমি কেনা ও দখলপ্রক্রিয়া সুন্দরবনের ভেতর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। যা হবে আরও ভয়ংকর।
ছাড়পত্র পায়নি কিন্তু ইসিএ এলাকায় জমি কিনে তাদের প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে আরও শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতা ও সমর্থক ব্যবসায়ী ওই এলাকায় নামে-বেনামে জমি কিনেছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
মোংলা উপজেলায় ১২টি, বাগেরহাটের শরণখোলায় ১ ও মোরেলগঞ্জ ২, সাতক্ষীরার শ্যামনগরে ৮, খুলনার কয়রায় ৪৯ ও দাকোপে ৩৩টি প্রকল্পকে পরিবেশ অধিদফতর থেকে ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। তবে এই ছাড়পত্রগুলোর বেশির ভাগই দেওয়া হয়েছে ওই এলাকাকে ইসিএ ঘোষণা করার আগে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১৮ জানুয়ারির আগে। ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ২১টি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উৎপাদনকারী প্রকল্প রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে উল্লেখ্যযোগ্য প্রতিষ্ঠান গুলো হচ্ছে ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লি., ওমেরা পেট্রোলিয়াম, পেট্রোডেক এলপিজি, পেট্রোম্যাক্স, বসুন্ধরা এলপিজি গ্যাস লি., এসকেএস এলপিজি লি., রূপসা ট্যাংক টার্মিনাল অ্যান্ড রিফাইনারি।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ইনডেক্স পাওয়ার অ্যান্ড এনার্জি লিমিটেডের পরিচালক তানিম নেওয়াজ দাবি করেন, তাদের শিল্পপার্কটি সুন্দরবন থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে। তাই সেটি এই আইনের আওতায় পড়ে না। ছাড়পত্র পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ৫০টি চালকল, ১৯টি করাতকল, সিমেন্ট কারখানা ৯টি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরন প্রতিষ্ঠান ১৩টি, ৬টি অটো মিল, ৪টি লবণ-পানি বিশুদ্ধকরণ প্রকল্প, দুইটি জাহাজ নির্মান প্রকল্প ও অন্যান্য ৩৮ টি প্রকল্প রয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ছাড়াও ইটভাটা আইন এবং করাতকল বিধিমালা অনুযায়ী বনভূমির পাশে করালতল ও ইটভাটা স্থাপন নিষেধ।

হানিফের সানমেরিন: সুন্দরবনের লাগোয়া জয়মনিরগোল গ্রামে সানমেরিনের নামে ৭০ একর জমি কেনা হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১০ সালে নিবন্ধন পাওয়া সানমেরিন শিপইয়ার্ড লি. কোয়েস্ট গ্রুপ অব কোম্পানির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। কোয়েস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহবুব উল আলম হানিফ। সানমেরিন শিপইয়ার্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন তার ভায়রা কাজী হাসান শরীফ। হাসান শরীফের নামেও জয়মনিরগোল গ্রামে ১৮০ একর জমি কেনা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নামে ২০১২ সালের ১৩ মে পরিবেশ অবস্থানগত ছাড়পত্র দেয়া হয়। সাগুফতা ইয়াসমিনের ভাই তোহা ইসলাম থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁর কেনা ৬০ একর জমিতে বর্তমানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মাছ চাষ করছেন বলে জানিয়েছেন সাংসদ সাগুফতা। ওই জমিতে কোনো প্রকল্প করবেন না, বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সাংসদ জানান। তোহা ওই জমিতে সেখানে সাইফ শিপইয়ার্ড লি. ও নিকসন্স লিমিটেড, গ্রিন রিসাইক্লিং শিপইয়ার্ড লি. নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ড স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সুন্দরবনের পাশে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ প্রায় ৬০০ একর জমি কিনেছে লিথি গ্রুপ। তবে আবেদন করা হলেও এখনো প্রতিষ্ঠানটিকে ছাড়পত্র দেয়া হয়নি। এ ব্যাপারে লিথি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবীর মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমাদের আশপাশে অনেক প্রতিষ্ঠানকেই একই ধরনের শিল্প স্থাপনের জন্য ছাড়পত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেয়া হচ্ছে না।’

কোথায় কী বিপদ: পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎপ্রকল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা, ইটভাটা মারাত্মকভাবে পরিবেশদূষণকারী বা লাল ও কমলা ক্যাটাগরির শিল্পপ্রতিষ্ঠান। সুন্দরবনের ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে সরকার ইতিমধ্যে দেশ ও বিদেশের পরিবেশবাদীদের আন্দোলন ও চাপের মুখে রয়েছে। তবে সুন্দরবনের পাশে ইসিএ এলাকায় বড় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু করে সরকারের খাদ্য বিভাগ। ২০১৩ সালে ৫০ হাজার টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি সাইলো (বড় খাদ্যগুদাম) এবং জেটি স্থাপন করেছে। সুন্দরবনের এক কিলোমিটারের মধ্যে নির্মিত এই সাইলো ও জেটি বর্তমানে পুরোদমে চালু রয়েছে।
গত এপ্রিলে ভারতের বন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় থেকে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ‘স্ট্যাটাস অব টাইগার ইন সুন্দরবন লেন্ডসস্কেপ ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সুন্দরবনের বাঘ ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি রামপাল তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী সম্ভাব্য শিল্পাঞ্চল।