আত্মঘাতীর বোমায় রক্তাক্ত পাকিস্তানের হাসপাতাল

 

আইনজীবীসহ নিহত ৯৩ আহত শতাধিক : টিটিপি ও আইএসের দায়িত্ব স্বীকার

মাথাভাঙ্গা মনিটর: পাকিস্তানের বেসামরিক হাসপাতালে আত্মঘাতীর বর্বর হামলায় নিহত হয়েছেন ৯৩ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগ আইনজীবী। এছাড়া দুজন সাংবাদিকও রয়েছেন। আহতদের ৩০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। গতকাল সোমবার বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের গেইটে এ হামলা চালান হয়। কেউ কেউ এ হামলাকে ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ বলে উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি) এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। পরে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএসও এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করে।

প্রিয়জনকে দেখতে এসেই নিহত: বেলুচিস্তানের স্বরাষ্ট্র সচিব আকবর হারিফাল জানিয়েছেন, গতকাল সকালে বেলুচিস্তান বার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট বিলাল আনোয়ার কাসিকে দুই অজ্ঞাত বন্দুকধারী মঙ্গল চৌকের মান্নু জান রোডে গুলি করে হত্যা করে। তার মৃতদেহ এমএস হাসপাতালে আনা হয়। জরুরি বিভাগে প্রবেশের সময়ই আত্মঘাতী হামলা চালান হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ সময় চারদিকে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। অনেকে জীবন বাঁচানোর জন্য পালাতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মারা যান। হাসাপাতালের মেঝে রক্তে ভেসে যায়। অনেক মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বেলুচিস্তান প্রদেশের মুখপাত্র আনোয়ার উল হক কাকার এই আত্মঘাতী হামলাকে পূর্বপরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক ফরিদউল্লাহ জানিয়েছেন, গুলিতে আহত আইনজীবী কাসির সাথে তার প্রিয়জনদের অনেকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রবেশ করতে যান। ঠিক সেই সময়ই হামলা চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বোমা হামলার সাথে গুলির শব্দও শোনা যায়। টেলিভিশন ফুটেজে দেখা গেছে, জরুরি বিভাগের জানালা দিয়ে ধোয়া বের হচ্ছে। হামলার পর সীমান্ত বাহিনীর সদস্যরা এবং পুলিশের একটি দল সেখানে পৌঁছায়।

প্রদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রধান ড. মাসুদ নওশেরবানি জানিয়েছেন, হামলায় ৭০ জন নিহত হয়েছেন এবং ১১২ জন আহত হয়েছেন। তবে বেসামরিক হাসপাতালের পরিচালক আব্দুল রেহমান ৬৩ জনের নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছেন। এদের অধিকাংশই আইনজীবী। তিনি জানান, তারা আহত ৯২ জনের চিকিত্সা করছেন। এছাড়া আহতদের মধ্যেও বেলুচিস্তান বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট বাজ মোহাম্মদ কাকারসহ অনেক আইনজীবী রয়েছেন। এ সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন ডন পত্রিকার ক্যামেরাম্যান মাহমুদ খান এবং আজ টিভির ক্যামেরাম্যান শেহজাদ খান। তারা দুজনই নিহত হয়েছেন। পুলিশ ৪২ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। এর আগে বেলুচিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রেহমাত বেলুচ ৯৩ জন নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছিলেন। কোয়েটার ওই হাসপাতালে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

এমএস মেডিকেল বোলান কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা আইয়ূব কাকার জানিয়েছেন, আহত ৩০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আইএসপিআর জানিয়েছে, আশঙ্কাজনক অবস্থায় ২২ জনকে সামরিক বিমানে করে বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল জানিয়েছে, বোমার ওজন হবে ৮ কেজি। একজন আত্মঘাতীর বিচ্ছিন্ন পা পাওয়া গেছে। ফরেনসিক বিভাগের একটি দল আলামত সংগ্রহ করেছে।  হামলার পর ফেসবুকে ‘সেফটি চেক’ নামে একটি পেইজ খোলা হয় যেখানে হতাহতদের খোঁজ-খবর জানা এবং রক্তসহ বিভিন্নিভাবে সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়।

দাবি এবং দায়িত্ব স্বীকার: হামলার পর বেলুচিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী সানাউল্লাহ জেহেরি দাবি করেন, এই সন্ত্রাসী হামলার পেছনে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (র) এর হাত আছে। হামলার প্রকৃতি জানা এবং প্রাথমিক তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে এ দাবি করেন। তবে গতকাল রাতে এক ই-মেইল বার্তায় টিটিপি’র মুখপাত্র এহসানউল্লাহ এহসান জানিয়েছেন, তাদের অঙ্গসংগঠন জামায়াত-উর-আহরার এ হামলা চালিয়েছে। শিগগিরই এ হামলার ভিডিও প্রকাশ করা হবে। তিনি ভবিষ্যতে আরো এ ধরনের হামলা চালানোর প্রতিজ্ঞা করেন। তবে তাদের এ দায়িত্ব স্বীকারের সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। কারণ এর আগে বিভিন্ন হামলার দায়িত্ব স্বীকার করলেও সেগুলোর সাথে তাদের সংযোগ পাওয়া যায়নি। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের তালিকায় জামায়াত-উর-আহরার এর নাম যুক্ত করে। দ্য ন্যাশন পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানায়, ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস) বা ডায়েশ এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে।

বেলুচিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরফরাজ বুগতি জানিয়েছেন, এখানে নিরাপত্তার ঘাটতি ছিলো। তিনি নিজে এ হামলার তদন্তের সাথে কাজ করবেন। তিনি জানান, এর আগে হাসপাতালে কোনো ধরনের হুমকি এসেছিলো বলে তার জানা নেই। হাসপাতালে হামলার পর পুলিশের প্রধান সিন্ধু প্রদেশজুড়ে উচ্চ সতর্কতা জারি করেছেন। পাকিস্তান বার কাউন্সিল আজ মঙ্গলবার দেশব্যাপী ধর্মঘট এবং এক সপ্তাহের শোক ঘোষণা করেছে।

লক্ষ্য ছিলো আইনজীবীরা: বেলুচিস্তানে গত কয়েক মাস ধরে আইনজীবীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। গত সপ্তাহে জানজেভ আলভি নামে এক আইনজীবীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গতকাল নিহত প্রেসিডেন্ট বিলাল কাসি আলভির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চরম নিন্দা জানিয়েছিলেন। প্রতিবাদে তিনি দুই দিন আদালত বর্জনের ঘোষণা করেছিলেন। এর আগে গত জুনে ইউনিভার্সিটি অব বেলুচিস্তানের আইন বিভাগের অধ্যক্ষ আমানুল্লাহ আচাকজাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গত এক দশক ধরে আয়তনে পাকিস্তানের বড় প্রদেশ বেলুচিস্তানে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গত ১৫ বছর ধরে সংখ্যালঘু শিয়া এবং হাজারা সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে ১৪শ’ হামলার ঘটনা ঘটেছে। আফগানিস্তান এবং ইরান সীমান্তের কাছে অবস্থিত এই প্রদেশে বেলুচ বিচ্ছিন্নতবাদীরা আন্দোলন করছেন। তাদের আল কায়েদা এবং অন্যান্য কিছু জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ রয়েছে।

নিন্দা: পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মামনুন হোসাইন, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারিসহ দেশটির বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ এবং সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ।