সাংবাদিক হাফিজ মাস্টারকে মনে পড়ে

 

রহমান মুকুল: স্মৃতি কেবলি যাতনাময়। কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি কেবল বেদনা মন্থন করেই চলে না, রীতিমত সমগ্র সত্ত্বা ও অস্তিত্বকে আমূল নাড়িয়ে যায়, তুমুলভাবে প্রকম্পিত করে তোলে। তেমনি অজস্র সর্বগ্রাসী স্মৃতি রয়েছে হাফিজ ভাইকে নিয়ে। আমার অস্তিত্বজুড়ে রয়েছে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি। সহকারী হিসেবে কাজ করলেও অলক্ষ্যে তিনিই ছিলেন আমার অভিভাবক। এক যুগেরও অধিক সময় আমাদের এ নিবিড় সম্পর্কের সুদৃঢ় বন্ধন। এমন আপন স্বজন হারানোর বেদনা ও দুর্ভাগ্য মেনে নেয়া সত্যিই অসাধ্য লাগছে। প্রতি মুহূর্তের হৃদয়ের যে রক্তক্ষরণ তা বলার নয়।

 

হাফিজ ভাইয়ের মতো শাদামাটা মনের অসম্ভব সরল-সোজা মানুষটিকে ঘিরে আমাদের রয়েছে অজস্র গল্প । আমার হৃদয়ে তার রেডিয়ামের মতো উজ্জ্বল উপস্থিতি কোনোদিন এতটুকু ম্লান হবে না। তাকে ঘিরে আমাদের কতো না বলা গল্প, কতো ভালবাসা! গ্রাম ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির মানুষের প্রতি তার গভীর ভালোবাসা ও দুর্বলতা ছিলো। একদিন দুপুরে আলমডাঙ্গা হাইরোডের ফরিদ ভাইয়ের চা দোকানে বসে আছি। হঠাত হাফিজ ভাই বললেন, আচ্ছা মুকুল, এতো বছর হলো আলমডাঙ্গা শহরে এসেছি, অথচ রাতে স্বপ্ন দেখলেই শুধু গ্রামের স্বপ্ন দেখি কেন? একদিনও তো আলমডাঙ্গার স্বপ্ন দেখিনে। তিনি প্রচুর অপ্রচলিত গ্রামীণ শব্দ ব্যবহার করতেন। যার বেশির ভাগই আমরা এখন প্রায় ভুলে গেছি। তার বসার কতো স্টাইল। আসনগুলোর কতো রকম নাম দিয়েছিলেন তিনি। ইলেক্ট্রনিক্স এবং ইলেক্ট্রিক বিষয়ে সীমাহীন কৌতূহল ছিলো তার। প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা খুলে ধারণা নিতে গিয়ে যেভাবে নষ্ট করেছেন তার গল্প। প্রথম মোবাইল কিনে একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের যত্ন নিতে গিয়ে পেট্রোল ওয়াশ করে নষ্ট করার গল্প, মোটরসাইকেলের কার্বরেটরের পিন ঘষে একটু বেশি চিকন করতে গিয়ে যে বিপত্তি ঘটালেন-তার গল্প, হাতের কাছে কিছু না থাকলে ঘরের ভালো টেলিভিশনটা অথবা কম্পিউটার খুলে নষ্ট করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেকানিকের ঘরে বসে থাকার গল্প, তার অভিমান ও ক্ষোভ প্রকাশের গল্প এবং তা বেমালুম ভুলে যাওয়ার গল্প। অস্তিত্বের পরতে পরতে জড়িয়ে যে স্মৃতি, তাকে বিস্মৃত করা কি আদৌ সম্ভব?

 

হয়তো ধীরে ধীরে একদিন পৃথিবীর আপন নিয়ম মেনে সবকিছু গা সওয়া হয়ে যায়। তাকে হারানোর যন্ত্রণার পাষাণভার এতোটা বেদনাদায়ক হয়ে হৃদয়ে বাজবে না। কিন্তু সত্যিই কি তাকে ভুলে যাওয়া যাবে? কক্ষনো না। জীবনের বিভিন্ন কোলাহলে, বিভিন্ন প্রয়োজনে, বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে, একান্ত বিষন্ন দুপুর, উদাসী বিকেল অথবা কষ্টের দীর্ঘ নিশীথে তার স্মৃতি বারে বারে মনে পড়বে। তাকে পাশে না পাওয়ার আপসোসে বুকের ভেতরটা হা-হাকার করে উঠবে। বেদনার সকরুণ রাগিনীতে হৃদয়ের তন্ত্রিগুলো ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠবে। অফুরন্ত এ কান্নার দমক চলতেই থাকবে জীবনব্যাপী। হাফিজ ভাইয়ের গল্প বলার কথা মনে পড়তেই আরেকটি উদ্ধৃতি চলে এলো হঠাত।

এক গ্রামে অবিরাম গল্প বলা এক পাগলাটে লোক ছিলেন। তিনি যাকে পেতেন তাকে ধরেই বিরতিহীন গল্প বলে যেতেন। শ্রোতা আদৌ শুনতে চায় কি-না, যে বিষয়ে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ থাকতো না। গল্পের যন্ত্রণায় সকলে তাকে এড়িয়ে চলতেন। ওই গ্রামের পৃথক এক ব্যক্তি শহরে চাকরি করতেন। একদিন অফিসে বের হতে তার কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত পৌঁছুতে তিনি মাঠের ভেতর দিয়ে চলা শুরু করেন। কিছুক্ষণ যেতেই তার সাথে গল্প বলা পাগলাটে লোকটির দেখা হয়ে গেল। তিনি যথারীতি অফিসে গমনেচ্ছু লোকটির শার্টের একটি বোতাম ধরে গল্প বলা শুরু করলেন। ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ২০ মিনিট, এক ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও তার অবিরাম গল্প বলার অন্ত নেই। লোকটি ক্ষ্যাপাটে গল্পবাজের হাত থেকে নিস্তার পেতে পকেট থেকে ব্লেড বের করে ধরে রাখা জামার বোতাম কেটে নিয়ে অফিসে ছুটলেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে । বিকেলে অফিস থেকে বের হয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। যেতে যেতে সেই মাঠের ভেতর দেখেন ক্ষ্যাপাটে লোকটি ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে শার্ট থেকে কেটে দেয়া বোতামটি ধরে গল্প বলে যাচ্ছেন। নন স্টপ।

ক্ষ্যাপাটে গল্পবাজ লোকটির মত হাফিজ ভাই’র গল্প বলা অবশ্যই আমাদেরও কোন দিন শেষ হবে না।