ল্যাপটপে ১৫ জঙ্গির তালিকা : নজরদারিতে ৬ কমান্ডার

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে পলাতক ছয় অপারেশনাল কমান্ডারকে গোয়েন্দা নজরদারিতে আনা হয়েছে। এ ঘটনায় করা মামলায় অন্যদের সাথে আসামি করা হয়েছে এই ছয়জনকেও। বর্তমানে আত্মগোপনে থাকা এসব জঙ্গির কাছে রয়েছে অস্ত্র ও গ্রেনেড। আহত জঙ্গি রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে। এছাড়া ওই আস্তানা থেকে নয় জঙ্গির অডিও বার্তা উদ্ধার করেছেন গোয়েন্দারা। ল্যাপটপে পাওয়া গেছে ১৫ জঙ্গির নামের তালিকা।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চিকিৎসাধীন জঙ্গি হাসানের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এজাহারভুক্ত ১০ জনের মধ্যে এ ছয়জনের বিষয়ে খোঁজ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এদের কাছে অস্ত্র ও গ্রেনেড আছে এমন তথ্য দিয়েছে হাসান। তাদের অবস্থানের বিষয়ে সম্ভাব্য তথ্য মিলেছে। যেকোনো সময় ওই এলাকায় অভিযান চালাতে পারে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী।

নজরদারির আওতায় আনা ছয় জঙ্গির মধ্যে একজনের বাসা ধানমণ্ডি। সে তার বাড়ির পাশেই হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। এখানে বিদেশি অতিথিদের যাতায়াত ছিলো। হামলার বিষয়ে কল্যাণপুরের ওই আস্তানায় তারা বৈঠক করে। কিন্তু গোপন খবর পেয়ে গোয়েন্দারা এ হামলা ভেস্তে দেয়।

পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি) ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, আশা করছি গোয়েন্দা জালে একে একে ধরা পড়বে জঙ্গিরা। উদ্ধার করা সম্ভব হবে আরও নেপথ্যের নায়কদের নাম। তিনি বলেন, যারা নিখোঁজ হয়ে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়েছে তাদের ধরতে গোয়েন্দা জাল তৈরি করা হয়েছে। এদের কোথায় আস্তানা আছে, সে বিষয়ে গোয়েন্দারা কাজ করে যাচ্ছেন।

কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় পাওয়া গেছে একটি ভাঙা ল্যাপটপ। জঙ্গিদের ব্যবহৃত এ ল্যাপটপ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ছক। ১৫ জনের নামের তালিকাও পাওয়া গেছে। একই স্থান থেকে পোশাক ছাড়াও নিহত জঙ্গিদের অডিও রেকর্ড পাওয়া গেছে। ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে রেকর্ড উদ্ধার করেন গোয়েন্দারা। জঙ্গিরা তাদের অডিও বার্তায় বাবা-মাকে ভুল পথ ছেড়ে জিহাদের পথে আসারও আহ্বান জানায়। রেকর্ডের একটি কপি তারা দেশের বাইরেও পাঠায়।

সংশ্লিষ্টদের ধারণা, মৃত্যুর আগে তারা বার্তাগুলো রেকর্ড করে। নির্দিষ্ট স্থানে এগুলো পাঠানোর পর মুছে ফেলে। কিন্তু শুক্রবার রিকভার ডাটা দিয়ে বার্তাগুলো উদ্ধার করা হয়। একই সঙ্গে জঙ্গিদের নির্দেশদাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী সম্পর্কেও নতুন তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জব্দ করা অন্যান্য আলামত থেকেও নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে জঙ্গিদের একটি তালিকাও আছে। তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ডের এলাকাও ছিল ভাগ করা। এরা তিনটি সেলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এসব সেলের নেতৃত্ব রয়েছে তিনজন। এদের একজনের মোবাইলে আরও একটি নতুন অ্যাপস ব্যবহারের তথ্য পাওয়া গেছে। এ অ্যাপস সারাদেশে মাত্র ২০ থেকে ২৫ জন ব্যক্তি ব্যবহার করে। এসব ব্যক্তির তালিকাও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এছাড়া কল্যাণপুরে নিহত জেএমবি সদস্যদের একাধিক বড় ভাই বিভিন্ন এলাকার অপারেশনাল কমান্ডার ছিল। তামিম তাদের সবাইকে ক্লোজড করে নিয়ে আসে ঢাকায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

জানা গেছে, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রিপন নিহত জঙ্গিদের কথিত বড় ভাই। এই রিপন জেএমবির নতুন টিমের একজন অপারেশনাল কমান্ডার। তার সম্ভাব্য বাড়ি রাজশাহী এলাকায়। রিপন ওই অঞ্চলে সংঘটিত বিভিন্ন হামলায় সরাসরি জড়িত ছিলো। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের ১১টি হামলার মধ্যে অধিকাংশ ঘটনায় সে কমান্ডার হিসেবে কাজ করে। সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, এজাহারভুক্ত আরেক আসামি মানিক সারা দেশের কো-অর্ডিনেটর ও অপারেশনাল কমান্ডার। সে বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকতো। বাদল নামের একজনও অপারেশনাল কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। তার বাড়ি বগুড়ার শাহজাহানপুরে। সে বগুড়ায় বিভিন্ন হামলায় জড়িত। রয়েছে গাইবান্ধার আজাদুল কবিরাজও। গুলশান হামলার পরই তার নাম উঠে আসে। সে জেএমবির উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একজন।

রিপন ও আজাদুল একসঙ্গে উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। আর নতুন জঙ্গিদের রিক্রুট করে রাজীব ও সাকিব। জঙ্গি খালেদকে কেউ কেউ মামা খালেক বলে ডাকে। সে দিনাজপুরে ছিল। কিন্তু প্রকৃত বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। খালেদের এক প্রধান শিষ্যের নাম আরিফুল। তার বাড়িও দিনাজপুরে। এ খালেদও আঞ্চলিক অপারেশনাল কমান্ডার। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা খালেদের দলে বিজয় নামে আরও এক যুবকের সন্ধান পেয়েছে। সে অস্ত্র পরিচালনায় পারদর্শী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মো. দিদার আহাম্মদ বলেন, মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে জঙ্গিদের খুনি চক্রে সক্রিয় করা হলেও এদের নেপথ্যে সরকারবিরোধী শক্তি অর্থ ঢালছে। কথিত জিহাদের নামে হামলায় জঙ্গিদের নামানো হলেও তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, জঙ্গিদের তামিমের মাধ্যমে অর্থ দেয়া হতো। তামিমকে কারা অর্থ দেয়, তার অনুসন্ধান চলছে।

কল্যাণপুরের ঘটনায় এজাহারে আসামির তালিকায় যাদের নাম আছে এদের মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী অন্যতম। সে গুলশান ও শোলাকিয়া হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী। এ ব্যক্তি জঙ্গিদের নানা নির্দেশনা ও অর্থায়ন করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন হাসানের তথ্যে কল্যাণপুরের ঘটনায় জেএমবির নতুন অপারেশনাল কমান্ডার ও কো-অর্ডিনেটরদের নাম এসেছে। এছাড়া অপারেশনাল কমান্ডাররা কল্যাণপুরে নিহত জঙ্গিদের কথিত বড় ভাই হিসেবে পরিচিত। যারা সিরিয়াল কিলিং মিশনে নেপথ্যের চিহ্নিত নায়ক। কল্যাণপুরে অভিযানের পর করা মামলায় এদের ১০ জনের নাম উল্লেখ রয়েছে। ইতোমধ্যে গোয়েন্দারা তাদের বিষয়েও তথ্য পেয়েছেন।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, গুলশানে নিহত নিবরাসের নিখোঁজের বিষয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি ধানমণ্ডি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছিল। ওই ডায়েরিতে তাওসিফের নিখোঁজের কথা উল্লেখ আছে। সে মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলায় তাওসিফকে পলাতক হিসেবে দেখনো হয়। রিয়াজ ওরফে কাচ্চি, সালভি আলী ওরফে মালাভী, ইয়াসিন তালুকদার ও গালিব নামে আরও কয়েকজন জঙ্গিকে ধরতেও অভিযান চলছে। এদের সাথে কল্যাণপুরের জঙ্গিদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তামিমের সহযোগী তাওসিফ একটি সেলের প্রধান। এই তাওসিফ ঝিনাইদহের আস্তানায় নিবরাস ও আবীরের সঙ্গে ছিল। শোলাকিয়া হামলায় আটক জঙ্গি শফিউলের কাছে এ তথ্য জানা যায়।

কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্র জানায়, এজাহারে নাম আসা অন্য জঙ্গিদের মধ্যে ইকবাল, মামুন, জোনায়েদ খানসহ অজ্ঞাতনামা যারা রয়েছে তাদের আটকে চেষ্টা চলছে। এরা বিভিন্ন স্থানে হামলার সঙ্গে জড়িত। তারাও বিভিন্ন কিলিং মিশন সেলের প্রধান হিসেবে কাজ করে। এদের অনেকেই ভারি অস্ত্র চালাতে পারে।