গাংনীতে ছোট ভাই পক্ষের হামলায় আহত বড় ভাইয়ের মৃত্যু

 

সাহেবনগর থেকে ফিরে মাজেদুল হক মানিক: ২২ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়ে হেরে গেলেন মেহেরপুর গাংনী উপজেলার সাহেবনগর গ্রামের কৃষক আব্দুল হাই (৫৫)। পূর্ব শত্রুতার জেরে ছোট ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও তার লোকজনের হামলায় গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সোমবার মধ্যরাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। হামলার পেছনে প্রতিবেশী হাবিব মেম্বারের পরিকল্পিত প্রতিশোধ বলে অভিযোগ করেছেন নিহতের স্বজনরা। হাবিব মেম্বার ও তার ভাই লাল্টুর অপকর্মের পথের কাটা আব্দুল হাইকে সরাতেই তার আপন সহোদরকে কাছে টেনে হীন উদ্দেশ্য হাসিল করেছে। আর হাবিব মেম্বারের পেছনের শক্তি তার ভাই ৱ্যাব ও ডিবির সোর্স পরিচয়দানকারী লাল্টু ওরফে লাল্টু কানা। নিহতের স্বজন ও গ্রামের কিছু মানুষ এমন অভিযোগ করে হত্যাকারী ও শক্তিদাতার গ্রেফতার পূর্বক সাজা দাবি করেছেন। আব্দুল হাইয়ের মৃত্যুতে পরিবারসহ গ্রামজুড়ে এখন শোকের ছায়া বিরাজ করছে। নিহত আব্দুল হাই সাহেবনগর গ্রামের মৃত ফজলু সর্দ্দারের ছেলে।

নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, নিহত আব্দুল হাইয়ের ছোট ভাই আব্দুল আওয়ালের বাড়ির উঠোনে আরেক ভাই আব্দুর রাজ্জাকের ছাদের পানি পড়ে। এই তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকতো। এর জের ধরে গত ২৭ জুন সকালে আবারো ঝগড়া শুরু হয়। এক পর্যায়ে আব্দুর রাজ্জাক ও তার স্ত্রী এবং তার পক্ষের কয়েকজন মিলে আব্দুল হাইকে লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। মাথা ও পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম আব্দুল হাইকে প্রথমে গাংনী ও পরে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে সোমবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গতকাল সকালে লাশ নিজ বাড়িতে আনার পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে লাশের ময়নাতদন্তের জন্য মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালমর্গে প্রেরণ করেন গাংনী থানার এসআই আবু বক্কর। বিকেল মরদেহ বাড়ি ফিরিয়ে আনার পর গ্রাম্য করবস্থানে জানাজা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়। একদিকে স্বামীর মৃত্যু অন্যদিকে একমাত্র ছেলে বিদেশে থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছেন নিহতের স্ত্রী আফরোজা খাতুন। একমাত্র মেয়ে ও ছেলের স্ত্রীকে নিয়ে পুরুষ শূণ্য বাড়িতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তবে হামলা মামলার পরেও আসামিরা বাড়িতে অবস্থান করলেও মৃত্যুর খবর শুনে গা ঢাকা দিয়েছে।

গতকাল বিকেলে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, লাশ কবরস্থানে নেয়ার পর নিহতের বাড়ির সামনে গ্রাম ও আত্মীয় স্বজনদের নারীদের ভিড়। চেয়ারে বসে শুধুই চোখের পানি ফেলছেন আফরোজা খাতুন ও তার মেয়ে। হত্যাকারী ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগ করে আসামিদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করছেন তিনি।

আফরোজা খাতুন জানান, সেদিনের হামলার সূত্রপাত ছাদের পানি পড়া হলেও এর পেছনে রয়েছে গত ইউপি নির্বাচনের বিরোধ। নির্বাচনে প্রতিবেশী মেম্বার প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিবের পক্ষ নেয় আব্দুল হাইয়ের আপন ভাই আব্দুর রাজ্জাক। অপরদিকে দীর্ঘদিন ধরে সাবেক মেম্বার আনারুল ইসলাম নাড়ার পক্ষে ছিলেন আব্দুল হাই। স্বাভাবিক ভাবেই দুই ভায়ের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। নির্বাচনে কাজিপুর ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ড মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হন হাবিব। বিজয়ের পরই সে আব্দুল হাই ও তার লোকজনের ওপর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে ওঠে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে চড়াও হতে থাকে। এছাড়াও হাবিব মেম্বারের ভাই লাল্টু মিয়া ওরফে লাল্টু কানার মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে স্বোচ্ছার ভূমিকা ছিলো আব্দুল হাইয়ের। সব মিলিয়ে আব্দুল হাইকে পথের কাটা মনে করে তা পরিস্কার করতে পরিকল্পনা করে হাবিব মেম্বার। আপন সহোদর আব্দুর রাজ্জাককে হাতে নেয়। ছাদের পানি পড়া নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া শুরু হলে সুযোগ নেয় হাবিব ও তার লোকজন। হাবিব ও তার কাছের লোক কামাল হোসেন, তৌহিদুল ইসলাম ও আতাহার আলীসহ কয়েকজনকে নিয়ে আব্দুর রাজ্জাকের বাড়ির পাশের বাঁশ বাগানে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে আব্দুর রাজ্জাককে সাথে নিয়ে লাঠিসোটা, রড ও ধারালো রামদা নিয়ে আব্দুল হাইয়ের ওপর হামলা চালায়। তাকে উপযুপরি পিটিয়ে মাথা, পা ও পেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাত্ব জখম করে। আব্দুল হাই মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার মৃত্যু হয়েছে মনে করে সটকে পড়ে হাবিব ও আব্দুর রাজ্জাকসহ তার পক্ষের লোকজন।

এদিকে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসায় আব্দুল হাই কিছুটা সুস্থ হলে মামলার উদ্যোগ নেন। গত ২৯ জুন চিকিৎসাধীন অবস্থায় স্বজনরা তাকে গাংনী থানায় নিয়ে আসেন। নিজে বাদি হয়ে আব্দুর রাজ্জাককে প্রধান আসামি করে হাবিবসহ আরো ছয়জনকে আসামি করে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলা দায়ের শেষে তাকে আবারো কুষ্টিয়া মেডিকেল ফিরিয়ে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে মামলা তদন্ত করতে শুধুমাত্র একদিন পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন ছাড়া কোনো ভূমিকা পালন করেননি বলে অভিযোগ নিহতের পরিবারের। আসামি গ্রেফতারে পুলিশের তেমন কোনো ভূমিকা ছিলো না। এর পেছনে হাবিব মেম্বারের ভাই লাল্টু ও ওরফে লাল্টু কানার অদৃশ্য ক্ষমতা কাজ করেছে বলে মনে করছেন নিহতের স্বজনরা।

নিহতের স্বজন ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ, এলাকার এক সময়কার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদকব্যবসায়ী লাল্টু ওরফে লাল্টু কানা ডিবি পুলিশ ও ৱ্যাবের সোর্স হিসেবে নিজেকে জাহির করে। তার দুচোখ অন্ধ হলেও সে মোবাইলের মাধ্যমে এখনো এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। কিন্তু ৱ্যাব ও ডিবির ভয় দেখানোর কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলেনা। তার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কেউ প্রতিবাদও করতে পারেন না। প্রতিবাদকারীদের ৱ্যাব ও ডিবি দিয়ে গ্রেফতারের ভয় দেখিয়ে অন্ধত্বের অন্তরালে নানান অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন এলাকার মানুষ। তবে অভিযোগকারীরা ভয়ে নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্ত দিয়েছেন। হাবিব মেম্বারের পেছনের শক্তি হিসেবে কাজ করে লাল্টু। এ কারণে আব্দুল হাই এর পরিবার মামলা করে চরম বিপাকে পড়েছেন। মামলা তুলে নিতে লাল্টু ও হাবিব ও তার লোকজন নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়েছে। এমনকি স্বপরিবারে হত্যা করার হুমকিতে দিশেহারা নিহতের পরিবার।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হাবিব মেম্বার ও তার ভাই লাল্টু জানান, তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতার বশে অভিযোগ উত্থাপন করা হচ্ছে। কোনো খারাপ কাজ ও আব্দুল হাই হত্যাকাণ্ডের  সাথে তারা জড়িত নন।

তবে লাল্টু ওরফে কানা লাল্টু ৱ্যাব ও ডিবির সোর্স নয় বলে জানান ৱ্যাব-৬ গাংনী ক্যাম্প কমান্ডার ও ডিবির ওসি। লাল্টু যদি কাউকে ভয় দেখায় তবে ৱ্যাব ও ডিবিকে অবহিত করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। লাল্টুর মাদকব্যবসা ও অপকর্মের বিষয়ে ৱ্যাব ও ডিবি ছাড় দেবে না বলেও হুশিয়ারী করেন ৱ্যাব ও ডিবি কর্মকর্তা। ভুক্তভোগীরা যদি লাল্টুর বিষয়ে তথ্য দেয় তাহলে দ্রুত তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন ডিসি ওসি।

গাংনী থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন জানান, নিহতের দায়ের করা মামলাটির সাথে এখন হত্যা মামলার ধারা যুক্ত হবে। মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর আসামিরা গা ঢাকা দিয়েছে। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

নিহতের পারিবারিক পরিচয়: এ উপজেলার সীমান্তবর্তী কাজিপুর ইউনিয়নের সাহেবনগর গ্রামের মৃত ফজলুল হক সর্দ্দারের ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে নিহত আব্দুল হাই মেজ। দাম্পত্য জীবনে তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে ইকবাল হোসেন কুয়েত প্রবাসী। একমাত্র মেয়ে বিবাহিতা। পেশায় একজন কৃষক ছিলেন তিনি।