দেশি জঙ্গিদের সাথে বাইরের যোগাযোগ আছে

স্টাফ রিপোর্টার: মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেছেন, বাংলাদেশের ভেতরে বেড়ে ওঠা জঙ্গিদের সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের যোগাযোগ আছে বলে তার দেশ মনে করে। তবে এসব যোগাযোগ কীভাবে ঘটে এবং জঙ্গিদের লক্ষ্য কী, তা জানতে তাঁর দেশ বদ্ধপরিকর। গতকাল মঙ্গলবার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল চ্যানেল-২৪ কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। রাতে ওই সাক্ষাৎকারটি প্রচার করে টিভি চ্যানেলটি।
সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১১ জুলাই থেকে তিন দিনের ঢাকা সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এছাড়া তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী এবং পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সাথে বৈঠক করেন। এ ছাড়া তিনি কূটনীতিক, বিভিন্ন পেশাজীবী ও পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে মতবিনিময় করেন।
আলোচনায় উপস্থিত লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গুলশানে রেস্তোরাঁয় হামলায় জড়িত জঙ্গিদের সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের যোগাযোগ থাকার কথা নিশা দেশাই উল্লেখ করেছেন।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের উপস্থিত কর্মকর্তারা নিশা দেশাইকে উদ্ধৃত করে গতকাল সকালে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ প্রতিদিন নিত্যনতুন চেহারা নিয়ে হাজির হচ্ছে। গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলা তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে, বাংলাদেশের সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেধাবী সন্তানদের এ ধরনের ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে পড়াটা কিছুটা অভিনবও বটে, যা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনের ক্ষেত্রে এক নতুন অভিজ্ঞতা। গুলশানের সন্ত্রাসী হামলায় জড়িত জঙ্গিরা এ দেশে বেড়ে উঠেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে তাদের সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর যোগসূত্রের বিষয়টি স্পষ্ট।
একই বিষয়ে নিশা দেশাই বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা একে অন্যের কাছ থেকে শিখছে, এটা আমরা দেখেছি। ১ জুলাইয়ের হামলায় দেখেছি, আইএসআইএল বা আমরা যাদের দায়েশ হিসেবে অভিহিত করি, তারা হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। হোমগ্রোন (দেশে বেড়ে ওঠা) নেটওয়ার্কের সাথে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের যোগাযোগ আছে। আসলে কীভাবে এসব যোগাযোগ ঘটে এবং তারা কী চায়, এটি আমরা বিস্তারিত জানতে বদ্ধপরিকর। ওই সব নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দেয়া এবং তাদের ধ্বংসাত্মক ও অন্ধকার মতাদর্শ রুখে দেয়া বিশ্বের সব নাগরিকের, সব সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ। ঐক্যবদ্ধভাবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমরা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে এসেছি।’ বাংলাদেশ সফর শেষে নিশা দেশাই গতকাল তার টুইটে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসী হামলা মোকাবিলা ও তদন্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তার জন্য সুনির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। কূটনীতিক সম্প্রদায় ও ব্যবসায়ী নেতাদের সাথে আলোচনা করেছি। তারা উদ্বিগ্ন হলেও বাংলাদেশের পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছেন।’
নিশা দেশাইয়ের টুইটের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল বিকেলে বলেন, সোমবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সাথে তার সচিবালয়ের দফতরে আলোচনার সময় মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের পক্ষে সহযোগিতার একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেন। ওই প্রস্তাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সামর্থ্য বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্র কোথায় কোথায় সহযোগিতা দেবে তা বলা আছে। সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা বলেন, সরকারের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় জঙ্গি হামলা মোকাবিলায় সরকারের কার্যকর কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা, সেটি বুঝতে চেয়েছেন নিশা দেশাই। বিশেষ করে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে জঙ্গি হামলায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে তা প্রতিহত করতে সরকারের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি জানার চেষ্টা করেন। তবে এসব আলোচনা শেষে তার মনে হয়েছে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সরকারের পদক্ষেপে ঘাটতি আছে।
সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশের কূটনীতিকদের পাশাপাশি বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের বাড়তি পদক্ষেপের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। তবে তিনি এটাও মনে করিয়ে দেন, বিদেশি নাগরিক মানে শুধু কূটনীতিক নন; বিদেশি বিনিয়োগাকারী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোকজন বাংলাদেশে রয়েছেন। এসব নাগরিকের মধ্যে বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে, প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশে বিনিয়োগ ও ব্যবসার স্বার্থে তাদের আশ্বস্ত করার বিষয়টিতে সরকারের গুরুত্ব দেওয়া উচিত। জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘গুলশানের হামলায় যে হোমগ্রোন (দেশে বেড়ে ওঠা) জঙ্গি জড়িত তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমরা সব সময় জঙ্গিদের সাথে আন্তর্জাতিক যোগসূত্রের বিষয়টি অস্বীকার করে আসছি। কিন্তু ওই হামলা শেষে আইএসের দাবির পর আমরা এখন কী বলব? আপনি মুখ ফুটে বলতে পারছেন না, হোমগ্রোন জঙ্গিরা আইএসের আদর্শ ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক সংগঠনটির সাথে তাদের তো যোগাযোগ হয়েছে। তা না হলে তাদের ছবি আইএসের সাইট থেকে প্রথম পাওয়া গেল কীভাবে! ওই ছবি প্রচার না হলে জানতেই পারতাম না জঙ্গি হামলায় কারা জড়িত ছিলো। তখন পুলিশের কথাই বিশ্বাস করতে হতো যে আকাশ, বিকাশ, ডনরা ওই হামলা চালিয়েছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে দূরে বসেও দুই পক্ষের যোগাযোগ অনায়াসে সম্ভব।’ জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, গুলশানের হামলা যে হুট করে ঘটেনি, তা ঘটনা প্রবাহ থেকে স্পষ্ট। কাজেই সমস্যাটা যেমন জটিল, এর সমাধানও হুট করে হয়ে যাবে, এটা ভাবা ঠিক নয়। তবে জঙ্গিবাদ দমনে ধৈর্যের সাথে সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমাধানের উপায় ঠিক করতে হবে।