নিকটজনেরা মুখ না খুললেও ফেসবুকে পরিচয় ফাঁস : ওরা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান

 

স্টাফ রিপোর্টার: গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি রেস্টুরেন্টে হামলা ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ সংঘটনকারী এবং পরে নিহত বন্ধুকধারীরা সবাই  উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। পড়াশোনা করেছে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পরিবারের ভেতরে থেকেই কখন যে তারা জড়িয়ে পড়েছিলো জঙ্গি কার্যক্রমে তা বুঝতেই পারেননি পরিবারের সদস্যরা। সবাই স্বেচ্ছায় ঘর ছেড়ে পালিয়েছিলো। তাদের সন্ধান করতে পুলিশের দারস্থ হয়েছিলো তাদের অভিভাবকরা। কিন্তু তদন্ত শেষে পুলিশ তাদের খুঁজে দিতে পারেনি। তবে দুই-একজনের পরিবারকে পুলিশ জানিয়েছিলো তারা বিদেশে চলে গেছে। কি কারণে গেছে বা কাদের সাথে গেছে তার কোনো সদুত্তর মেলেনি। অবশেষে সেই ঘর পালানো ছেলেরাই কি-না আবির্ভূত হয়েছিলো দুর্ধর্ষ জঙ্গি হিসেবে।

এদিকে গত শনিবার আইএসপিআর এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কমান্ডো অভিযানে ৬ বন্ধুকধারী নিহত হয়েছে বলে জানায়। পরে শনিবার রাতে পুলিশ ৫ জনের লাশের ছবি প্রকাশ করে যা গতকাল ছাপা হয়। পুলিশ জানায়, এই পাঁচজনই জঙ্গি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে জানা যায় এর মধ্যে একজন হলি আর্টিজানের বাবুর্চি সাইফুল ইসলাম। অন্য চারজনের ছবি হামলাকারী হিসেবে শনাক্ত হয়। তারা হলো-রোহান ইমতিয়াজ, নিব্রাস ইসলাম, মীর সামিহ মোবাশ্বির ও তাসিন রওনক আন্দালিব।

প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে নিহত অন্য দুই হামলাকারীর ছবি কোথায়? তাদের ছবি এখনও কেউ প্রকাশ করেনি। আইএসপিআরের প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়েছে, ছয় বন্ধুকধারী ছাড়াও একজনকে আটক করা হয়েছে। তার নাম সৌরভ। ঘটনাস্থল থেকে ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন বিদেশি এবং ৩ জন বাংলাদেশি। এই ২০ জনের পরিচয়ও দিয়েছে আইএসপিআর। কিন্তু সাইফুলের ছবি সনাক্ত হওয়ার পর এ হিসাব আর মিলছে না। এদিকে যে চারজনের নাম পরিচয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে তারা হলেন রোহান ইমতিয়াজ, মীর সামিহ মোবাশ্বির, নিব্রাস ইসলাম ও তাসিন রওনক আন্দালিব।

রোহান ইমতিয়াজ: আওয়ামী লীগের ঢাকা মহানগর কমিটির যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ইমতিয়াজ খান বাবুলের ছেলে রোহান ইমতিয়াজ (২০)। তিনি বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল এবং বাংলাদেশ সাইক্লিস্ট ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি। ইমতিয়াজ খান বাবুল সাবেক সংসদ সদস্য হাজী মকবুল হোসেনের শ্যালক। ফেসবুক দেখে বোঝা যায়, তিনি কিছুদিন ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ২১ জুন তিনি ফেসবুকে ছেলের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘প্লিজ কাম ব্যাক’। তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন। নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি।  মোহাম্মদপুর থানাধীন লালমাটিয়ার জি ব্লকের ৯/৭ নম্বর বাড়ির পাঁচতলার ফ্ল্যাটে তিনি গত ৭ বছর ধরে সপরিবারে ভাড়া থাকেন। রোহান স্কলাসটিকায় পড়াশুনা শেষ করে পড়ছিলেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। তার মা স্কলাস্টিকার শিক্ষক। গতকাল রোহানদের লালমাটিয়ার ভাড়া বাসায় গেলে সাংবাদিকদের ওই বাসায় প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। বাড়ির নিরাপত্তা প্রহরী নূরুন্নবী বলেন, ৫/৬ মাস আগে রোহান বাসা থেকে নিখোঁজ হয়ে যায়। তবে এ ব্যাপারে তারা বাবা অনেক খুঁজেছেন কিন্তু পাননি। খুব শান্ত প্রকৃতির ছিল রোহান। তবে তার সাথে হামলাকারীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিলো কি-না তা তিনি জানেন না। তিনি আরো বলেন, পত্রিকায় রোহানের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর পরিবার বাসায় তালা দিয়ে চলে গেছে। তবে রবিবার রাতে ওই বাসায় রোহানের পরিবারকে অবস্থান করতে দেখা গেছে। তবে ফ্ল্যাটের দরজা না খুললেও ভিতর থেকে রোহানের মা পরিচয় দানকারী এক মহিলা বলেন, তার সন্তান খুব মেধাবী ছিলো। তবে হামলাকারী নিহতদের ছবির মধ্যে তার ছেলের ছবি নেই বলে তিনি দাবি করেন।

মীর সামিহ মোবাশ্বির: গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টার দিকে মীর সামিহ মোবাশ্বির  গুলশানের এমিনেন্স কোচিংয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে করে বাসা থেকে বের হয়। যানজট থাকায় কোচিং সেন্টারের আগেই গাড়ি থেকে নেমে যায়। পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে গাড়িচালক জুয়েল তাকে কোচিং থেকে আনতে গেলে তাকে আর পাওয়া যায়নি। পরে মোবাশ্বিরের বাবা মীর এ হায়াত কবীর ওই দিনই গুলশান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (নম্বর ১৮৪৮) করেন। পুলিশ তার খোঁজ করতে গিয়ে গুলশান এলাকার সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পায়, মোবাশ্বির গাড়ি থেকে নামার পর একটি রিকশা নিয়ে বনানীর ১১ নম্বর সড়কের দিকে চলে যাচ্ছে। মুবাশ্বেরের বাবা অ্যালকাটেল-লুসেন্ট বাংলাদেশের কর্মকর্তা। মা খালেদা পারভীন সরকারি কলেজের শিক্ষক। বড় ভাই পড়ছেন কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে। মোবাশ্বির স্কলাসটিকা স্কুল থেকে সমপ্রতি ও-লেভেল সম্পন্ন করেছে। এ লেভেলে ভর্তি হওয়ার জন্য সে গুলশানের এমিনেন্স কোচিং সেন্টারসহ দুটি কোচিং সেন্টারে পড়ছিল। পরিবারের সাথে সে বনানী ডিওএইচএসের ৫ নম্বর সড়কের ৬৮/এ বাসার ৫/বি ফ্ল্যাটে থাকতো। গতকাল ৬৮/এ নম্বর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, রোহানের পরিবারের মত তারাও ফ্ল্যাটে তালা ঝুলিয়ে চলে গেছেন। মোবাশ্বিরের ছবি শেয়ার করে ফেসবুকে নিঝুম মজুমদার লিখেছেন, আমার ফেসবুকের বন্ধু/ছোটভাই আমাকে কনফার্ম হয়ে জানাল, এই ছেলেটির নাম মীর সামিহ মোবাশ্বির। যেহেতু দীর্ঘদিন একজন আরেকজনকে চেনেন। এই ছেলেটি এই বছরের মার্চ মাস থেকে মিসিং। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। এ লেভেল পরীক্ষার আগ থেকেই মিসিং ছিলো। ঢাকায় নিহত হামলাকারীদের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে তা দেখেই তারা শনাক্ত করেছেন। ছবিটি আইডেন্টিফাই করা ব্যক্তি এও বলেছেন, ছেলেটাকে একটু মোটা লাগছে কিন্তু প্রচুর মিল আছে তা বলা বাহুল্য। তিন মাস যদি মিসিং থাকে, তাহলে এই সময়ের ট্রেনিংয়ে শারীরিক এই অবয়ব হয়তো সম্ভব।

নিব্রাস ইসলাম: হামলাকারীদের আরেক জন নিব্রাস ইসলাম নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। সাবেক সহাপাঠীরা শনাক্ত করে তার ছবি ও পরিচয় সামনে এনেছেন। বলা হচ্ছে, নিব্রাস অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট সার্ভিসেসের কোষাধ্যক্ষ ছিলো।  ওয়ারী ও উত্তরায় বাড়ি থাকা নিব্রাস ধনী পরিবারের সন্তান। পড়েছে ঢাকার ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলে। নিব্রাসের তিন চাচার মধ্যে একজন সরকারের উপ-সচিব, একজন পুলিশের এএসপি, আরেকজন বিজ্ঞানী। দ্য এশিয়া ফয়েলসের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ নেওয়াজ লিখেছেন, আমি আমার চিন্তাগুলোকে এক জায়গায় করতে চেষ্টা করছি। হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত দুই জনকে আমাদের অনেকেই চেনে। কয়েক বছর আগে এদেরই একজনকে (নিব্রাস ইসলাম) আমি কাছ থেকেই দেখেছি। এদেরই একজন ফুটবল খেলতে পছন্দ করতো, তার আচরণের জন্য বেশ জনপ্রিয় ছিল। এই ছেলেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে চেক-ইন দিতে পছন্দ করতো। গত ফেব্রুয়ারি থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।

তাসিন রওনক আন্দালিব: নিহত হামলাকারী ৫ জনের মধ্যে একজনের ছবি শনাক্ত করা হয়েছে তাসিন রওনক আন্দালিব নামে। এর আগে আন্দালিব ধানমন্ডির সানিডেল স্কুল থেকে ও লেভেল পাশ করে। সে মালয়েশিয়ায় মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে নিব্রাস ইসলামের সহপাঠী। তাদের এক সাথে ছবি ফেসবুকে প্রকাশ হয়েছে। ফেসবুকে প্রকাশিত ছবি থেকেই নিহত হামলাকারীর একজনের ছবির সাথে মিল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে অপর একজনের ছবি সাইফুল ইসলাম নামে একজন হলি আর্টিজান বেকারীর একজন কর্মচারীর। ওই রেঁস্তোরার মালিক সাদাত মেহেদি বলেন, পত্রিকায় সাদা রঙের টি-শার্ট পড়া যে ছবি প্রকাশ হয়েছে সেটি তার রেঁস্তোরার কর্মচারীর।