গতিরোধ করে হোমিও চিকিৎসককে কুপিয়ে খুন : ইবির শিক্ষক জখম

কুষ্টিয়ার বটতৈল শিশিরমাঠ নামকস্থানে মোটরসাইকেযোগে আসা অজ্ঞাত দুর্বৃত্তের কিলিংমিশন

1463730939

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়া সদরের বটতৈলে এক হোমিওপ্যাথ চিকিৎসককে কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সদর মডেল থানার ওসি শাহবুদ্দিন চৌধুরী জানান, গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে বটতৈল ইউনিয়নের শিশিরমাঠ এলাকায় হামলার শিকার হন হোমিও চিকিৎসক মীর সানাউর রহমান ওরফে সানোয়ার ও তার বন্ধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান। সানাউর ওরফে সাইফুজ্জামানের মধ্যে বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। সানাউর বাউল মতের অনুসারী ছিলেন। তার সাথে সাইফুজ্জামানও প্রায়ই বাউল গানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতেন।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গতকাল সকালে মোটরসাইকেলে করে কুষ্টিয়া শহরতলির মজমপুর থেকে বটতৈল হয়ে শিশিরমাঠে যাচ্ছিলেন ওই শিক্ষক ও চিকিৎসক। শিশিরমাঠ এলাকায় একদল দুর্বৃত্ত তাদের পথরোধ করে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে জখম করে। এতে ঘটনাস্থলেই চিকিৎসকের মৃত্যু হয়। স্থানীয়রা দ্রুত শিক্ষক সাইফুজ্জামানকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. তাপস কুমার সরকার জানান তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

এদিকে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ইবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম সরকারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ সময় ইবির উপাচার্য জানান, সাইফুজ্জামানের জন্য ইবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে।

প্রসঙ্গত, কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব মজমপুর এলাকার বাসিন্দা ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক ডা. সানাউর রহমান। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল ইউনিয়নের নিভৃতপল্লি শিশিরমাঠ নামক এলাকায় তার একটি বাগানবাড়ি ছিলো। সেখানে তিনি দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে ওই এলাকার গরিব-দুস্থ মানুষের বিনামূল্যে হোমিও চিকিৎসা করে আসছিলেন। চিকিৎসক সানাউল্লাহ মুক্তচিন্তার মানুষ ছিলেন। এলাকায় ভালো মানুষ হিসেবে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিলো। তার চিকিৎসা কাজে সহযোগিতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক এমনকি অন্য ডাক্তাররা তার বাগানবাড়িতে যেতেন। প্রতি শুক্রবার তিনি নিয়মিত রোগী দেখতেন। ইবির এই শিক্ষক ভারতের শান্তিনিকেতনে পিএইচডি করে ৬ মাস আগে দেশে ফিরে আসেন। তবে তাদের হামলার পেছনে মুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যার ধারাবাহিকতায় এ ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করছেন মুক্তচিন্তার মানুষরা। সেই বাগানবাড়িতে গরিব রোগীদের চিকিৎসা করতেন সোহেল রানা নামে তার আরেক সহযোগী। তিনি বলেন, নিহত সানাউর রহমান একাকী নীরবে-নিশ্চিন্তে দিন কাটাতে পছন্দ করতেন। অনেক আগে তার স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর একাকী বসবাস করতেন। তার এক ছেলে ঢাকায় বসবাস করেন তবে তার কোন শত্রু ছিলো না। নিজে মুসলমান হলেও সব ধর্ম নিয়েই তিনি গবেষণা করতেন। মজমপুর এলাকার এক বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আধ্যাত্মিক জগতের এক মানুষ ছিলেন সানাউর রহমান। শিশিরমাঠের সেই বাগানবাড়িতে শুক্রবার রোগী দেখলেও জুমার নামাজের সময় তিনি মসজিদে যেতেন না। নামাজও পড়তেন না। এছাড়াও তার বাগানবাড়ির কিছুদূর পর খ্রিস্টান ধর্মের উপাসনালয় রয়েছে সেখানে তিনি নিয়মিত যেতেন।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হোমিও চিকিৎসক মীর সানোয়ার হোসেন (৫৫) ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাইফুজ্জামান (৩৮) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বটতৈল শিশিরমাঠ এলাকায় নিজ দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে একদল মোটরসাইকেল আরোহী সন্ত্রাসী তাদের গতিরোধ করে এবং তাদের দুজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কোপাতে থাকে। এতে হোমিও চিকিৎসক সানোয়ার ঘটনাস্থলেই নিহত হন। ইবির অধ্যাপক সাইফুজ্জামান গুরুতর আহত হন।

ঘটনার পর স্থানীয়রা ইবির ওই অধ্যাপককে কুষ্টিয়া ২৫০ বেড জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালে ভর্তির পর তাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়। তার দেহে দু ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়। কিন্তু অবস্থার তেমন উন্নতি না হওয়ায় ডাক্তাররা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় রেফার্ড করেন। দুপুরে কুষ্টিয়া হাসপাতাল থেকে অধ্যাপক সাইফুজ্জামানকে ঢাকায় নেয়া হয়। আহত শিক্ষক সাইফুজ্জামানকে বেলা একটার দিকে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী সোনিয়া সুলতানা। হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ পুলিশ জানাতে পারেনি বলে জান গেছে। তবে জমি-জমা সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে। এছাড়া এ ঘটনার সাথে জঙ্গিদের কোনো সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখছে বলে পুলিশ জানায়।

বিকেল ৪টার দিকে সানোয়ারের ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালমর্গে ময়নাতদন্ত করেন অরবিন্দ পাল ও আশরাফুল হাসান। সানোয়ারের ঘাড়ের ওপরে ও মাথার পেছনে ৪ থেকে ৫টি আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তাতেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।

কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে পূর্ব শত্রুতার জেরে সানোয়ারকে হত্যা করা হতে পারে। তার মাথার পেছনে ধারালো অস্ত্রের ৩টি কোপের চিহ্ন রয়েছে। শিক্ষকের মাথার পেছনেও কোপ দেয়া হয়েছে।

বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ সুপার বলেন, সানোয়ারের বাংলো বাড়ির জমি নিয়ে কোনো বিরোধ, রোগী দেখা বিষয়ে নারীঘটিত কিছু, পূর্ব শত্রুতা থাকতে পারে বলে এগুলোকে প্রাথমিকভাবে হত্যার কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে আমরা এটা ভাবছি না। তবে সব বিষয় নিয়েই পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে।

কুষ্টিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ঘটনাস্থল থেকে একটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। দুর্বৃত্তের অস্ত্রের কোপে ছিন্ন হয়ে যাওয়া শিক্ষকের হাতের দুটি আঙুলও ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।

নিহত হোমিও চিকিৎকের স্বজনরা জানায়, সমাজ হিতৈষী ও সংস্কৃতিমনা সানোয়ার হোসেন বটতৈল শিশিরমাঠ এলাকায় নিজস্ব জমিতে একটি বাগানবাড়ি গড়ে তোলেন এবং গত ১২/১৩ বছর যাবত ওই বাগানবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্রে গরিব-অসহায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন। ওই চিকিৎসালয়কে কেন্দ্র করে হোমিও চিকিৎসক সানোয়ারের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে গড়ে উঠে সখ্যতা ও সুসম্পর্ক।

কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের চিকিৎসক তাপস কুমার সরকার জানান, তার জন্য ৪ সদস্যের মেডিকেল টিম করা হয়েছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।