বিবর্তনের ধারায় হ্রাস পাচ্ছে মানুষের ঘুম!

 

পুরোনো বিশ্বাস আখড়ে রাখলে যেমন নতুনকে নতুনের মতো পাওয়া যায় না, তেমনই অনেক অভ্যাসও অজান্তেই পেয়ে বসে মানুষকে। ছেদপড়ে গতানুগতিকতায়। যেমন সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরার বিষয়টি নিশ্চিত করার আগে মানুষ বিশ্বাস করতো সূর্যই পৃথিবীর চতুরদিকে ঘোরে। তাছাড়া সয়ে নেয়া বা সহনীয় করে তোলার বিষয়টিতেও রয়েছে ধারাবাহিকতার ছোঁয়া। বিবর্তনেরই ধারা। যেমন গরুর দুধ একদিনে মানুষের শরীরে সহনীয় হয়নি, তেমনই ঘুমের পরিমাণও কি এবার হ্রাস পেতে শুরু করলো? বৈশ্বিক নিদ্রাসঙ্কটে ভুগছে পৃথিবী শীর্ষক প্রতিবেদনই মূলত এ প্রশ্ন সামনে অনেছে মানুষের। তথ্যটি উদ্বেগজনক বটে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে বলেছে, মোবাইলফোন ও কম্পিউটার অ্যাপের মাধ্যমে ১৫ বছর ও তদুর্ধ্ব প্রায় ছয় হাজার বিভিন্ন দেশীয় নর-নারীর ঘুমানো, জেগে ওঠা এবং আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে সময় কাটানোর অভ্যাসের ওপর তথ্যাদি সংগ্রহ করেন তারা। এর পাশাপাশি তাদের বয়স, লিঙ্গ, দেশ, পেশাসহ স্থানীয় সময়ের তথ্যও সংগ্রহ করা হয়। গবেষণা প্রতিবেদনটি গত শুক্রবার প্রকাশিত হয়েছে সায়েন্স অ্যাডভান্সেস সাময়িকীতে। আর তাতেই মিলেছে বিশ্বব্যাপী মানুষের ঘুম সম্পর্কিত নানা চমকপ্রদ তথ্য-উপাত্ত। প্রথমত বলা যেতে পারে ঘুমের সময় সম্পর্কে। অবশ্য দেশে দেশে কালে কালে এ নিয়ে মতভেদ আছে। কথা আছে বিভিন্ন বয়সীদের ঘুম নিয়েও। সাধারণভাবে বলা হয়, মধ্যবয়সী একজন মানুষের ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ঘুমের সময়সীমা ৭-৮ ঘণ্টা হওয়া বাঞ্ছনীয়। সর্বনিম্ন ছয় ঘণ্টা তো বটেই। আজকাল কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য দুপুরে অন্তত আধঘণ্টা ভাতঘুমের ওপরও গুরুত্বারোপ করে থাকেন। যা হোক, গবেষক দলের ভাষ্য হলো, বিশ্বব্যাপী মানুষের সেই ঘুমের সময়সীমা কমে যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সামাজিক চাপ ও জীবনধারায় পরিবর্তনের কারণে প্রায় সর্বত্র মানুষ বাধ্য হচ্ছে কম ঘুমাতে। নিদ্রা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আধঘণ্টা কম ঘুমালে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের বোধশক্তি ও দৈনন্দিন স্বাস্থ্যের ওপর। অনিদ্রায় ভুগলে কমে মানুষের বোধশক্তি। একটানা দীর্ঘদিন ঘুম কম হলে স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি থাকে। ঘুম সম্পর্কে এর বাইরেও মিলেছে আরও নানা চমকপ্রদ তথ্য। যেমন, পুরুষের তুলনায় অন্তত ৩০ মিনিট বেশি ঘুমান নারীরা। এমনকি তারা পুরুষের চেয়ে আগে ঘুমাতে যান; আবার জাগেনও দেরিতে। যেসব মানুষ প্রাকৃতিক আলো বা সূর্যালোকের সংস্পর্শে বেশি সময় কাটান সচরাচর তারা ঘুমিয়ে পড়েন আগেভাগেই। ডাচরা সিঙ্গাপুর ও জাপানের মানুষের চেয়ে এক ঘণ্টা বেশি ঘুমিয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি ঘুমায় নেদারল্যান্ডসের মানুষ, গড়ে ৮ ঘণ্টা ১২ মিনিট। যুক্তরাজ্যের মানুষ গড়ে ৮ ঘণ্টার একটু কম ঘুমায়।

বাংলাদেশের মানুষের ঘুমের ধরন ও অভ্যাস নিয়ে গবেষণালব্ধ কোনো তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে গত বছর বিশ্ব নিদ্রা দিবসে আয়োজিত এক সেমিনারে পরিবেশিত তথ্যে দেখা যায় ঘুমের পরিমাণ কমছে বাংলাদেশেও। মধ্যবয়সী পুরুষদের ৬০ শতাংশ এবং নারীদের ৪০ শতাংশ ভুগছেন ঘুমের সমস্যায়। অতিরিক্ত ওজন বা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা তথা নাক ডাকার কারণেও মানুষের ঘুমের সমস্যা হতে পারে। ব্যক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি পরিবেশগত সমস্যা, টেলিভিশন দেখা, কম্পিউটারে কাজ, মোবাইলফোনে আলাপ ইত্যাদি কারণেও মানুষের ঘুম বিলম্বিত হয়। তবে সমস্যা হলো- সমাজ ব্যবস্থা আমাদের ঠেলছে বেশি রাতে ঘুমাতে যেতে। অন্যদিকে দেহঘড়ি বলছে তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে। ঘুম কম হওয়ার এ এক মহাসঙ্কট! নিরন্তর এই দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে হবে মানুষকে। বৈশ্বিক নিদ্রাসঙ্কট সেক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতা মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে বিজ্ঞানীদের।

অনিদ্রাজনিত সমস্যার কারণে অল্পবিস্তর স্বাস্থ্যসমস্যাসহ নানা রোগ-ব্যাধি দেখা দিলেও মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। এটা কি মানুষের অভিযোজন ক্ষমতা নাকি ওষুধ-বিষুধের কারসাজি! আবার হতে পারে দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্য সচেতনতা। এমন তো হতেই পারে যে, মানুষের অভ্যন্তরীণ ঘড়ি বা জৈবঘড়ি সবকিছু এমনকি প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম। আগামীর কোনো গবেষণায় এর প্রমাণ মিললেও মিলতে পারে।