হত্যার পর নদীতে ফেলার জন্য লাশ করা হয় ৯ টুকরো

 

আলমডাঙ্গা ব্যুরো: অর্থের লোভে পালক চাচাতো ভাইকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ ৯ টুকরো করার পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েছে আলমডাঙ্গার পার্শ্ববর্তী নান্দিয়া-সুতাইল গ্রামের রাহেদুজ্জামান। গত সোমবার রাতে গাজী পাম্পের বিক্রয় প্রতিনিধি আখতারুজ্জামান ওরফে সরোজ মোল্লাকে (৩২) পাবনা শহরের ভাড়া বাড়িতে পাটা-নোড়া দিয়ে মাথায় আঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরে মৃতদেহ নদীতে ফেলার জন্য টুকরো টুকরো করে ৯টি ব্যাগভর্তি করে বাথরুমের ফলস সিলিঙের ওপর রাখে। ঘাতক ভাইকে পুলিশ আটক করেছে।

গতকাল বুধবার দুপুরে পাবনা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার আলমগীর কবির বলেন, ২ মে আখতারুজ্জামান অফিস শেষ করে বাসায় ফেরেন। ৩ মে তিনি অফিসে না গেলে অন্য স্টাফরা তার ভাড়া বাসায় যান। সেখানে গিয়ে রাহেদুজ্জামানকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানান, আখতারুজ্জামান ওরফে সরোজ মোল্লার স্ত্রীর শরীর খারাপ সে জন্য গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এদিকে সরোজ মোল্লার স্ত্রী বারবার তার মোবাইলফোনে রিং করেও যোগাযোগ করতে না পারায় তার অফিসে বিষয়টি জানায়। স্ত্রীর অনুরোধে কোম্পানির লোকজন ৩ মে সন্ধ্যায় আবার বাসায় যান। সেখানে গিয়ে দেখতে পান রাহেদুজ্জামান ব্যাগপত্র গুছিয়ে রিকশায় উঠছেন। এ সময় আখতারুজ্জামান সম্পর্কে কোম্পানির লোকজন রাহেদুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তার কথাবার্তায় গরমিল পাওয়া যায়। এতে সন্দেহের সৃষ্টি হলে তাকে ধরে থানায় নিয়ে যান তারা। থানায় পুলিশের জিজ্ঞাসাদে মুখ খোলে রাহেদুজ্জামান। সে আখতারুজ্জামান ওরফে সরোজ মোল্লাকে হত্যার কথা স্বীকার করে। তার স্বীকারোক্তি মোতাবেক মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে পাবনা শহরের কৃষ্ণপুর মহল্লায় জামিল হোসেনের ভাড়া বাড়ি থেকে পুলিশ সরোজ মোল্লার ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার করে।

পুলিশের নিকট দেয়া স্বীকারোক্তি মোতাবেক ও পারিবারিকসূত্রে জানা গেছে, আলমডাঙ্গা শহরের নিকটবর্তী কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার নান্দিয়া গ্রামের মৃত আলতাফ হোসেন ওরফে ফারুক মোল্লার ছেলে সরোজ মোল্লা (৩২) চাকরির সুবাদে পাবনার কৃষ্ণপুর মহল্লার জামিল হোসেনের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। তিনি গাজী ট্যাংকের পাবনার বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার সাথে থাকতেন তাদের একই বংশের চাচাতো ভাই একই এলাকার মৃত মোশারোফ হোসেনের ছেলে রাহেদুজ্জামান (২৮)। বংশের অনেকেই ভালো চাকরি বাকরি করা সত্ত্বেও অসৎ ও অসামাজিক স্বভাবের হওয়ায় রাহেদুজ্জামানকে কেউ চাকরি দিয়ে সহযোগিতা করতো না। রাহেদের এমন বিপদের দিনে হাত বাড়িয়ে দেন তার বংশের চাচাতো ভাই সরোজ মোল্লা। তিনি রাহেদকে পাবনায় নিয়ে যান চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে। খাওয়া-দাওয়াসহ নিজ ভাড়া বাড়িতে আপন ছোট ভাইয়ের মতো রেখেছিলেন রাহেদকে।  সম্প্রতি পবনা শহরে গাজী ট্যাংকের এক এজেন্টের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রাহেদকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। গত সোমবার পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নিজ মোটরসাইকেলযোগে বাড়িতে আসেন সরোজ মোল্লা। এ সময় অনেক অনুরোধ করলেও তার সাথে বাড়ি আসতে রাজি হয়নি রাহেদ। ওই দিনই অনুষ্ঠান শেষে দ্রুত পাবনায় ফেরেন সরোজ মোল্লা। চাচাতো ভাই রাহেদকে নিয়ে শহরে কালেকশনে বের হন সরোজ মোল্লা। ১০ লাখ টাকা কালেকশন করে রাতে ঘরে ফেরার সময় তার একটু দেরি হবে জানিয়ে সরোজ মোল্লা রাহেদকে ঘরে পাঠিয়ে দেন। এরপর তিনি বিকাশে কালেকশনের টাকা পাঠিয়ে আরেক এজেন্টের নিকট থেকে ১৫ হাজার টাকা কালেকশন করে ঘরে ফেরেন। সে সময় ঘাতক রাহেদ সরোজ মোল্লাকে জানায়, সে আর এ চাকরি করবে না। ঢাকায় ভালো চাকরি পেয়েছে। সেখানে যাবে। ৫ হাজার টাকার দরকার, আমাকে দাও। তখন সরোজ মোল্লা তার কাছে টাকা নেই সব টাকা বিকাশ করেছে বলে জানায়। আগামীকাল বেতন তুলে তোকে ৫ হাজার টাকা দেব বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বিশ্বাস করেনি ঘাতক রাহেদ। রাতে দু ভাই খেয়ে গল্প করতে করতেই পরিশ্রান্ত সরোজ মোল্লা রুমের দেয়ালে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। তার ঘুমিয়ে পড়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে ঘাতক রাহেদ রান্না ঘরে থাকা নোড়া নিয়ে গিয়ে প্রথমে সরোজের মুখের বামপাশের কানের গোড়ায় সজোরে আঘাত করে। পরে মাথায় আরেকটি আঘাত করে। এরপর নোড়া ফেলে পাটা নিয়ে গিয়ে মাথায় আরেকটি আঘাত করে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত হতে হাত পায়ের রগ কেটে দেয়। সরোজ মোল্লার মৃত্যু হলে ঘাতক রাহেদ ঘর তন্ন তন্ন করে কালেকশনের ১০ হাজার টাকা খোঁজাখুঁজি করে মাত্র ১৫ হাজার টাকা পায় তার মানিব্যাগে। হতাশ হয়। হতাশ রাহেদ ঘরে তালা আটকে বাজারে গিয়ে ধারালো ডাশা ও ৯টি সিমেন্টের বস্তার বড় ব্যাগ ক্রয় করে। ঘরে ফিরে পিড়ের নিচে কয়েকটি ইট দিয়ে উঁচু করে বসে প্রায় সারারাত নৃশংসভাবে লাশ কেটে কেটে টুকরো করে। প্রতিটা হাত ও পা ৩টি করে টুকরো করে। মাথা পৃথক, বুক-ধড় আড়াআড়িভাবে চিরে ফেলে। কলিজা, হৃদপিণ্ড, নাড়িভুড়ি একটি ব্যাগে ভরে। এভাবে ৯টি ব্যাগ ভর্তি করে বাথরুমের ফলস সিলিঙয়ের ওপর তুলে রাখে। এ সমস্ত করতে করতে সকাল হয়ে যায়। দিনের বেলা ব্যাগভর্তি লাশ নদীতে ফেলতে নিয়ে যাওয়া বিপদজনক। পরদিন মঙ্গলবার দিনগত রাতে সে ব্যাগগুলো নদীতে ফেলতে নিয়ে যাওয়ার প্লান করে। ডাসা, সরোজ মোল্লার মানিব্যাগ, ঘড়ি ও আংটি ঘাতক তার নিজ ব্যাগে ভরে রাখে। এক সময় সে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

পুলিশ সুপার আলমগীর আরও জানান, থানায় তার ব্যাগ তল্লাশি করে একটি ধারালো দা পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে হত্যার কথা স্বীকার করে। পাবনা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুল্লাহ আল হাসান বলেন, সরোজ মোল্লার চাচা মোজাম্মেল হক বাদী হয়ে বুধবার সকালে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ মামলায় রাহেদুজ্জামানকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

এদিকে, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ বিকেলে নিজ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বাদ আছর নান্দিয়া গ্রামের পারিবারিক গোরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে। ৭ মাসের এক কন্যা সন্তানের জনক সরোজ মোল্লা ৩ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে মেজো ছিলেন। গতকাল বিকেলে লাশ নিজ গ্রামে পৌঁছুলে নিহতের মা, ভাই-বোন, স্ত্রীসহ নিকটজনের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে।