চুয়াডাঙ্গায় অনাথ ছাত্রীকে ধর্ষণ মামলায় শিক্ষক আহাদ গ্রেফতার

2016-05-04-7093

চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গায় এতিম ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় শিক্ষক আহাদ আলীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ছাত্রীর দুলাভাই থানায় সন্ধ্যায় মামলা দায়েরের পর পরই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। রাতেই ধর্ষিত স্কুলছাত্রীকে হাসপাতালে নেয়া হয় ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। আহাদকে গ্রেফতারে অভিভাবক ও ছাত্রীদের মধ্যে ফিরে এসেছে স্বস্তি।

অভিযোগকারীরা জানান, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নেহালপুর গ্রামের ওয়াজেদ আলীর ছেলে মো. আহাদ আলী জেলা শহরের কোর্টপাড়ার ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সহকারী ইংরেজি শিক্ষক। তিনি বছর দেড়েক আগে শিক্ষক হিসেবে ওই স্কুলে যোগদান করেন।

সূত্র জানায়, কয়েক দিন আগে শিক্ষক আহাদ ৩দিনের ট্রেনিংয়ে বাইরে ছিলেন। তিনি চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার থানা কাউন্সিলপাড়ায় বোনের বাড়িতে থাকেন। শুক্রবার বাসায় কেউ ছিলো না। এই সুযোগে পরিকল্পিতভাবে একই এলাকার তার স্কুলের দশম শ্রেণির মানবিক শাখার এক ছাত্রীর দুলাভাইকে ফোন দিয়ে ছাত্রীকে প্রাইভেট পড়তে ডাকেন। ওই ছাত্রী গত শুক্রবার বেলা আড়াইটার দিকে শিক্ষক আহাদ আলীর বাড়িতে এসে দেখতে পায় শিক্ষক আহাদ ছাড়া বাড়িতে কেউ নেই। এমনকি তার কোনো সহপাঠীও পড়তে আসেনি। তখনই তার সন্দেহ হয়। সে বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলে শিক্ষক আহাদ ঘরের জানালা-দরজা বন্ধ করে দেন। এরপর তাকে চকলেট খেতে দেন। কিছুক্ষণ পর জাপটে ধরে তাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করেন। ধর্ষণ শেষে শিক্ষক বিষয়টি আর কাউকে না জানাতে নিষেধ করেন। কাউকে জানালে বড় ধরনের ক্ষতি হবে বলে ছাত্রীকে হুমকি দিয়ে দেন তিনি। কিন্তু ধর্ষিত ছাত্রী কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ফিরে তার দুলাভাইকে সব ঘটনা জানায়। দুলাভাই ঘটনাটি ম্যানেজিং কমিটিকে জানান। ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকরা ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য গোপনে কয়েক দফা বৈঠকও করেন। কিন্তু ধর্ষিত স্কুলছাত্রী বিষয়টি তার কয়েকজন সহপাঠীকে জানিয়ে দিলে অবস্থা বেসামাল হয়ে ওঠে। বিদ্যালয়ের সকল ছাত্রী বিষয়টি অবহিত হওয়ার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরই এক পর্যায়ে গতকাল বুধবার সকাল ৯টার দিকে বিষয়টি ছাত্রীদের কাছ থেকে অভিভাবক মহল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রীরাসহ উত্তেজিত অভিভাবকরা বিদ্যালয়ের আঙিনায় শিক্ষক আহাদকে গণধোলাই দিয়ে রক্তাক্ত জখম করে ছাড়েন। আহাদকে বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকরা উদ্ধার করে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে বসিয়ে রাখেন। কিন্তু ছাত্রীরা বাইরে বিক্ষোভ করতে থাকে এবং শিক্ষককে বের করে দিতে বলেন। প্রায় ঘণ্টা তিনেক অবরুদ্ধ করে রাখা হয় শিক্ষক আহাদকে। খবর পেয়ে স্কুলে ছুটে আসেন চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ড. এবিএম মাহমুদুল হক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আনজুমান আরা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক. সহকারী পুলিশ সুপার ছুফি উল্লাহ ও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোজাম্মেল হক। এ সময় শিক্ষক আহাদের বিচারের দাবিতে ছাত্রীরা বিক্ষোভ করতে থাকে এবং বিভিন্ন স্লোগান দেয়।

এক ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছে, সকালে শিক্ষক আহাদের বিষয়ে সভাপতির কাছে নালিশ করতে গেলে সভাপতি দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে চড়-থাপ্পড় মারেন। তবে থাপ্পড়ের বিষয়টি বিদ্যালয়ের সভাপতি অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম অস্বীকার করেন। আরেক ছাত্রীর অভিভাবক দুপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ওই শিক্ষকের নামে অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বিভিন্নভাবে ধর্ষিত ছাত্রীকে দায়ী করে শিক্ষককে রক্ষার চেষ্টা চালাচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। অভিযুক্ত শিক্ষক আহাদ ওই সময় ধর্ষণের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে এসব ষড়যন্ত্র। ওই ছাত্রীকে আমার সাথে বিয়ে দেয়ার জন্যই ঘটনা সাজানো হয়েছে।

দুপুরে স্কুলছাত্রীর দুলাভাই জানান, বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য নানাভাবে আমাকে হুমকি দেয়া হয়। প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা অভিযোগের বিষয়ে তেমন মুখ খোলেননি। তিনি বলেন, আমি তেমন কিছু জানি না। তবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার (আজ) সকাল ১০টায় বিদ্যালয়ে জরুরি সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে। তবে অভিভাকরা বলেছে আহাদকে রক্ষার চেষ্টা করছেন প্রধান শিক্ষক ও সভাপতিসহ কতিপয় শিক্ষক। এক অভিভাবক বলেন, এ ঘটনার পর আমার মেয়ে স্কুলে যেতে লজ্জা ও ভয় পাচ্ছে। স্কুলটি ছাত্রীদের জন্য নিরাপদ মনে হচ্ছে না। হয়তো মেয়ের পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে তাৎক্ষণিকভাবে ওই স্কুলসহ পার্শ্ববর্তী ঝিনুক বিদ্যাপীঠ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। তারপরেও বিক্ষুব্ধ ছাত্রীরা স্কুল প্রাঙ্গণেই অবস্থান নেয়। পরে পুলিশ তাদেরকে জোরপূর্বক বিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়। তবে এ সময় ছাত্রীরা ধর্ষক শিক্ষকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দেয়।

অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী স্মৃতি অভিযোগ করে বলেছে, ওই অবিবাহিত শিক্ষক ক্লাসে এসে আজেবাজে কথা শোনায়। কয়েকজন ছাত্রী বলেছে, বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানাগারে মোবাইলফোনে ছাত্রীদের অশ্লীল ও পর্নো ভিডিও দেখান স্যার। এর আগে ওই শিক্ষকের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে এক অভিভাবক তার মেয়েকে অন্য স্কুলে নিয়ে গেছে বলে জানান একজন অভিভাবক। ধর্ষিত স্কুলছাত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবিনগর গ্রামের অনাথ পরিবারের মেয়ে। তার বাবা নেই। সে চুয়াডাঙ্গা থানা কাউন্সিলপাড়ায় দুলাভাইয়ের বাসাবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করে।

দুপুরে স্কুলশিক্ষক আহাদকে পুলিশ প্রহরায় বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হলে ছাত্রী ও অভিভাবক মহলে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ সময় ধর্ষিতার পরিবারের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় চুয়াডাঙ্গা জেলা লোকমোর্চা। লোকমোর্চার সভাপতি অ্যাড. আলমগীর হোসেনের নেতৃত্বে ধর্ষিত স্কুলছাত্রীর দুলাভাই বাদী হয়ে সন্ধ্যার পর আহাদের বিরুদ্ধে চুয়াডাঙ্গা সদর থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন। এর কিছুক্ষণের মধ্যে পাশের বাড়িতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আহাদকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাকে থানা কাস্টডিতে আটক রাখা হয়েছে।

আর ধর্ষিত ছাত্রীকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতেই চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ রানার তত্ত্বাবধানে ধর্ষিত ছাত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. মাসুদ রানা জানান, ডা. আকলিমা খাতুনকে প্রধান করে ৩ সদস্যের মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। রাতেই ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয়েছে। অসুস্থতার কারণে স্কুলছাতীকে হাসপাতালে ভর্তি রাখা হয়েছে।

জেলা লোকমোর্চার সভাপতি অ্যাড. আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা ধর্ষিত ছাত্রীর পাশে আছি। যতো হুমকি-ধামকি আসুক না কেন অবশ্যই আইনের মাধ্যমে ধর্ষক শিক্ষকের বিচার নিশ্চিত করা হবে। তিনি জানান, বৃহস্পতিবার (আজ) নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় ধর্ষিত ছাত্রীর জবানবন্দি রেকর্ড করা হবে।