সুপ্রিম কোর্টে নিষ্পত্তি হওয়া ১৬৮ মামলা পুনঃশুনানিতে

স্টাফ রিপোর্টার: অবসর গ্রহণের পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতেই আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের কাছে থাকা ১৬১টি মামলার পুনশুনানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। পুনশুনানি করা হবে সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের কাছে থাকা সাতটি মামলারও। এর মধ্যে আগামী ২ মের দৈনন্দিন কার্যতালিকায় রয়েছে মামলাগুলো।

সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা রায়ের জন্য অপেক্ষমান বিচারপতি মানিক ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের এই মামলাগুলো পুনশুনানির নির্দেশ দেন। এই নিয়ে আইনাঙ্গণে তোলপাড় চলছে। একজন বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর এতো বিপুলসংখ্যক মামলার রায় প্রদান না করা নজিরবিহীন বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বেশিরভাগ মামলার রায় লেখার কাজ শেষ করেছিলেন বিচারপতি মানিক। কিন্তু তার লেখা রায় গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় প্রধান বিচারপতি মামলাগুলো পুনশুনানির আদেশ দিয়েছেন। এর পরপরই প্রস্তুত করা হয়েছে এসব মামলার পেপারবুক।

এদিকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধায় সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে আপলোড করা আপিল বিভাগের মামলার দৈনন্দিন কার্যতালিকা। ২ মের কার্যতালিকায় বিচারপতি মানিকের ১৬১টি ও সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের ৭টি মামলা পুনশুনানির জন্য রাখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বলেন, আমি এই আদেশের কপি দেখিনি। আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে বলতে পারবেন। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ১৬১টি মামলার রায় হইকোর্টে দাখিলের পর প্রধান বিচারপতি ওই রায়গুলো গ্রহণ না করে পুনশুনানির জন্য আদেশ দিয়েছেন। সারা পৃথিবীতে বিচার বিভাগের ইতিহাসে এই ঘটনা নজিরবিহীন। আমি মনে করি, এই বিষয়টি আমাদের বিচার বিভাগের বিশেষ করে উচ্চ আদালতের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ করেছে। ওই মামলাগুলোতে যারা বিচারপ্রার্থী ছিলেন- তারা ইতোমধ্যে মামলার ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েছিলেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের প্রত্যাশিত ফলাফল ভিন্নরকম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যার ফলে বিচার বিভ্রাট হবে। বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা সঙ্কট দেখা দেবে।

সিনিয়র এই আইনজীবী আরো বলেন, আমি মনে করি- এ বিষয়ে জনমনে বিভ্রান্তি দূর করার জন্য, কেন এই ধরনের ঘটনার প্রয়োজন হলো, সে বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট থেকে একটি সুনির্দিষ্ট বক্তব্য জনস্বার্থে প্রকাশ করা উচিত। নতুবা জনমনে এই ব্যাপারে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্ন দেখা দেবে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ইকতেদার আহমেদ বলেন, ফৌজদারি বা দেওয়ানি কার্যবিধি এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট বিভাগের নিয়ম পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মামলা শুনানি হওয়ার পর প্রকাশ্য আদালতে উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে রায় ঘোষণা করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো- প্রকাশ্য আদালতে কে বসতে পারেন? কর্মরত বিচারপতি বা বিচারক ব্যতীত অপর কারো প্রকাশ্য আদালতে বসার সুযোগ নেই। সুতরাং বিতর্কিত বিচারক মানিকের অবসর পরবর্তী রায় ঘোষণার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

২০১৫ সালের ১ অক্টোবর আপিল বিভাগ থেকে অবসরে যান বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। অবসরে যাওয়ার সময় ১৬১টি মামলার রায় লেখার দায়িত্ব ছিলো এই বিচারপতির। এসব মামলা তার অবসরে যাওয়ার আগেই আপিল বিভাগ বিভিন্ন সময়ে শুনানিগ্রহণ সম্পন্ন করেন। পাশাপাশি সংক্ষিপ্ত আদেশও জানিয়ে দেন। শুধু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ বাকি ছিলো। মামলাগুলোর রায় দীর্ঘদিনেও তিনি না লিখে কালক্ষেপণ করছিলেন। আর এমনই এক পরিস্থিতিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা গত ১৭ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের একবছর পূর্তি উপলক্ষে এক বাণীতে অবসরের পরে রায় লেখা সংবিধানপরিপন্থি বলে উল্লেখ করেন। ওই বাণীতে তিনি বলেন, কোনো কোনো বিচারপতি রায় লিখতে অস্বাভাবিক বিলম্ব করেন। আবার কেউ কেউ অবসর গ্রহণের পর দীর্ঘদিন সময় ধরে রায় লেখা অব্যাহত রাখেন, যা আইন ও সংবিধানপরিপন্থি। অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি বলার ব্যাখ্যায় বিচারপতি সিনহা তার বাণীতে বলেন, কোনো বিচারপতি অবসর গ্রহণের পর তিনি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে গণ্য হন বিধায় তার গৃহীত শপথও বহাল থাকে না। এরপর গত ২২ জানুয়ারি মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সভায় প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার পর আর কোনো রায় লিখতে দেয়া হবে না। আমাদের দেশে অতীতে এ রকম রায় দিলেও এখন থেকে আর এ সুযোগ দেয়া যাবে না। এরপর তীব্র সমালোচনার মুখে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক গত ৮ ফেব্রুয়ারি ৬৫টি মামলার রায় ও আদেশের কপি হাতে লিখে জমা দেন। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি আরো কিছু রায় লিখে জমা দেন। বিচারপতি মানিক তার কাছে আর কোনো মামলায় রায় লেখার কাজ বাকি নেই বলে তখন মিডিয়ার কাছে দাবি করেছিলেন। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আরো কিছু মামলার রায় লেখার অপেক্ষায় ছিলো। আর যেসব রায় তিনি হাতে লিখে জমা দিয়েছেন, সেগুলোর অনেক লেখাই অস্পষ্ট। পাশাপাশি আপিল বিভাগের যে বেঞ্চ হতে এসব মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে, সেই বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা এখনও এসব রায়ে স্বাক্ষর করেননি। নিয়ম অনুযায়ী কোনো মামলার রায় লেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারপতি রায়টি লেখার কাজ শেষ করার পর অন্য বিচারপতিরা তা দেখে একমত হয়ে স্বাক্ষর করেন। আর বেঞ্চের সব বিচারপতির স্বাক্ষর শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেটি রায় হিসেবেও গণ্য হয় না। যেসব মামলা পুনশুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এগুলোর মধ্যে ২০১৩ সালে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, এমন মামলাও রয়েছে। এছাড়াও অবসরের পরে লেখা রায়ের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এখন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে প্রধান বিচারপতি সবগুলো মামলারই পুনশুনানির আদেশ দিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।