১৮ বছর ধরে প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে আটকে রয়েছে ঐতিহাসিক মুজিবনগর স্মৃতি কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজ

 

মাজেদুল হক মানিক: অর্থ বরাদ্দের অভাবে মেহেরপুরের ঐতিহাসিক মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ কাজ আজও শেষ হয়নি। কয়েক দফা নকশা পরিবর্তন ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় নির্মাণ শুরু থেকে কেটে গেছে ১৮টি বছর। বৃহৎ এই প্রকল্পের বেশির ভাগ কাজ সম্পন্ন হলেও জনবল নিয়োগ না হওয়ায় বিনষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সব জিনিসপত্র। ফলে স্বাধীনতার শপথ ভূমি দর্শনার্থীদের মাঝে তুলে ধরার যে উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে তা বিফলে যাওয়ার পথে।

দেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে প্রথম রাজধানীখ্যাত মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর অন্যতম। মুজিবনগর আম্রকাননেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নিয়েছিলো। এরশাদ সরকারের আমলে প্রথম মুজিবনগরকে গুরত্ব দিয়ে স্বাধীনতার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২৩ স্তম্ভ বিশিষ্ট স্মৃতি সৌধ গড়ে তোলে। এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ৮০ একর জমি অধিগ্রহণ করে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রর কাজ শুরু করে। ১৯৯৮ সালের জুলাইয়ে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ওই সময় ব্যয় ধরা হয়েছিলো ২৯ কোটি ২১ লাখ টাকা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রল্পটির কাজ শুরু হলেও নির্মাণের দায়িত্বে ছিলো গণপূর্ত অধিদফতর। তবে নকশা ও পরিকল্পনাসহ যাবতীয় কাজের তদারকি ছিলো মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হাতে। ২০০১ সালে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এ সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি পুরো কাজ। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রকল্পটির ব্যয় ৪৭ কোটি ৭ লাখ টাকায় উন্নীত করে। তারপরও প্রকল্পটি অসম্পূর্ণ থাকায় অর্থের অভাবকেই দায়ী করেছে গণপূর্ত বিভাগের স্থানীয় দফতর।

মেহেরপুর গণপূর্ত অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ জানান, বছর তিনেক আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্মৃতিকেন্দ্রের কাজ পরিদর্শন করেন। কেন্দ্রটির নির্মাণ দ্রুত শেষ করা, দর্শনার্থীদের সুবিধার্থে ২০টি পাবলিক টয়লেট ও টিউবওয়েল স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিসংবলিত একটি ফটক নির্মাণের জন্য তারা বাজেট ও পরিকল্পনা প্রেরণের নির্দেশ দেন। তাদের নির্দেশনা মতো ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরে পরিকল্পনা পাঠানো হয় ২০১৪ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়নি। তাই বাকি নির্মাণকাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। অন্যদিকে দিন যতোই অতিবাহিত হচ্ছে ততোই বাড়ছে নির্মাণ ব্যয়। এখন নির্মাণ কাজ শুরু হলে ৫ কোটি টাকার বেশি প্রয়োজন হবে বলেও জানান তিনি।

মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কমপ্লেক্স, দেশের সর্ববৃহৎ মানচিত্র, প্রশাসনিক ভবন, অডিটোরিয়াম, প্লাজা, ছয় স্তর বিশিষ্ট গোলাপ বাগান, পর্যটন মোটেল, শিশু পরিবার, মসজিদ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতি ভাস্কর্য রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে কিছু কিছু কাজ সম্পন্ন হলেও তা জনবলের অভাবে অরক্ষিত। ফলে দর্শনার্থীদের জন্যও খুলে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে নির্মাণ করা মূল্যবান স্থাপনা বছরের পর বছর অযত্নে অবহেলায় বিনষ্ট হচ্ছে। মন্ত্রী ও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতিশ্রুতির বেড়াজালে আটকে রয়েছে নির্মাণ কাজ।

মুজিবনগর স্মৃতিকেন্দ্রে নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মধ্যে আরো রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্তদের আবক্ষ মূর্তি কক্ষ, মিলনায়তন, প্রশাসনিক ভবন। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংবলিত আরো কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা। এর মধ্যে প্রশাসনিক ভবন ও মিলনায়তনের কাজ কয়েক বছর আগে শেষ হলেও বিদ্যুত সংযোগ ও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে দর্শনার্থীদের জন্য তা খুলে দেয়া হয়নি।

মানচিত্রের বাইরে নির্মাণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের ম্যুরাল, ২৫ মার্চের কালরাত্রির চিত্র, পাকবাহিনীর নারী নির্যাতনের চিত্র, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান, ১২ আনসার কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান ও সেক্টর বণ্টনসহ অরোরা, নিয়াজি এবং একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্য সংবলিত ভাস্কর্য। সব মিলিয়ে মুজিবনগর দর্শনার্থীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত হচ্ছে। প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থী এখানে বেড়াতে আসেন। কিন্তু নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় অনেকটাই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।

স্থানীয় বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন জানান, প্রতি বছর বিভিন্ন দপ্তরের মন্ত্রী ও সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ১৭ এপ্রিল ঘিরে দৌড়ঝাঁপ করলেও মুজিবনগর দিবস পেরিয়ে গেলে তা আর চোখে পড়ে না। মুজিবনগরবাসী আমরা আর প্রতিশ্রুতি শুনতে চাই না। চাই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন।

এদিকে মুজিবনগর মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিকেন্দ্রের কাজ পূর্ণাঙ্গ শেষ না হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীরা কমপ্লেক্স ও স্মৃতিসৌধের কিছু কাজ দেখে ফিরে যাচ্ছেন। এতে হতাশ হচ্ছেন দর্শনার্থীরা। তবে স্মৃতিকেন্দ্র নির্মাণে নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার ও এর নকশা পরিবর্তনের কারণে নির্মাণকাজে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান মেহেরপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন দোদুল। তিনি বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে তারা মূল নকশা থেকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নকশা পরিবর্তন করে। নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহারের ফলে ম্যুরাল ও বিভিন্ন স্থাপনা সংস্কার প্রয়োজন হচ্ছে। তবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস দেশ-বিদেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করছেন বলে জানান তিনি।