মুজিবনগর সরকারের গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ আনসারের জীবিত ৪ জন

 

মহাসিন আলী: দেশ স্বাধীনের প্রায় পাঁচ দশকেও মুজিবনগর দিবসকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হয়নি। ঘোষণা করা হয়নি দিনটিকে সরকারি ছুটি দিন। এমন কষ্ট মনে নিয়ে আরো একটি মুজিবনগর দিবস পার করতে যাচ্ছেন দেশের প্রথম মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ আনসারের মধ্যে জীবিত চার আনসার সদস্য। জীবন সায়াহ্নে এসে সরকারের কাছে তাদের আরো দাবি মুজিবনগরে ৮ আনসারের ম্যুরালের সাথে আরো ৪টি ম্যুরাল স্থাপন করে তাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হোক।

মুজিবনগর সরকারে গার্ড অব অনার প্রদানকারী ষাটোর্ধ্ব আজিমউদ্দিন শেখ, লিয়াকত আলী ও সিরাজউদ্দিন জানান- অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে এক শ্বাসরুদ্ধ ও বিস্ময়কর মাহিন্দ্রক্ষণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম অন্য নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে তৎকালীন বৈদ্যনাথতলায় পৌঁছান। ততোক্ষণে দেশি-বিদেশি শতাধিক সাংবাদিক এবং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও সেখানে উপস্থিত হন। বহু প্রতিক্ষিত শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল এগারটায়।

মেজর আবু উসমান চৌধুরী পৌঁছাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দীন আহমেদ আনসারের একটি ছোট দল নিয়ে নেতৃবৃন্দকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণের পর স্থানীয় শিল্পীদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সৈদয় নজরুল ইসলাম সেখানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরে সরকার গঠনের অনুষ্ঠানিকতা শেষে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ উপস্থিত সকলের সামনে ৩০মিনিটের এক উদ্দীপনাময় ভাষন দেন। ভাষণে তিনি বলেন, আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী হবে এ বৈদ্যনাথতলা এবং এর নতুন নাম হবে মুজিবনগর। তিনি ভাষণে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। বক্তৃতা এবং শপথ গ্রহণ পর্ব শেষে নেতৃবৃন্দ মঞ্চ থেকে নেমে এলে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন মেজর আবু উসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে স্থানীয় ১২ জন আনসার সদস্য। উপস্থিত জনতার মূহুমূহু জয়বাংলা ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে মুজিবনগরের আম্রকানন। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ হয়।

এরপর বন্ধু প্রীতম ভারতের সহযোগিতায় মুক্তিকামী বাঙালি পাক হানারবাহিনীর সাথে লড়াই করে এবং ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত বিজয় পান বাঙালি জাতি। এরপর প্রতিবছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস পালন করা হয়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। কিন্তু স্বাধীনতার এতো বছর পরও মুজিবনগরকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়নি। ঘোষণা করা হয়নি ওই দিনকে সরকারি ছুটির দিন। পরিতাপের বিষয় চলতি বছরের এদিনটিতে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষা রাখা হয়েছে।

সেই থেকে স্বাধীনতার সূঁতিকাগার মুজিবনগর। আর মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ আনসারের মধ্যে জীবিত আছেন আর মাত্র চার আনসার সদস্য। তারা হলেন- মুজিবনগর উপজেলার ভবরপাড়া গ্রামের আজিমউদ্দিন শেখ (৮০), সোনাপুর গ্রামের হামিদুল হক (৭০), ভবরপাড়া গ্রামের লিয়াকত আলী (৬৫) ও একই গ্রামের সিরাজউদ্দিন (৬৬)।

সরকারিভাবে তাদের খাস জমি বরাদ্দ দেয়া হলেও আনসার সদস্য সিরাজউদ্দিন পাননি তার নামে বরাদ্দ দেয়া ৬১ শতক জমি। তার সংসারে তারা স্বামী-স্ত্রী ও ২ ছেলে-মেয়ে। আনসার সদস্য আজিমউদ্দিন শেখের সংসারে রয়েছেন ২ স্ত্রী, ৪ ছেলে ও ২ মেয়েসহ ৯ সদস্য। হামিদুল হকের সংসারে স্বামী-স্ত্রী, ৩ ছেলে ও ২ মেয়েসহ ৭ জন সদস্য এবং লিয়াকত আলীর সংসারে রয়েছেন স্বামী-স্ত্রী ও ২ ছেলে-মেয়েসহ ৪ জন। তাদের অনেকের ছেলে-মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে। তারা এখন পৃথক থাকে। আনসার সদস্য হামিদুল হক অসুস্থ। প্রতি মাসে প্রায় ৫ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। তারা প্রত্যেক আনসার সদস্য প্রতিমাসে পান ৮ হাজার টাকা ভাতা। এতে সংসারে তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তারা আরো জানালেন- ১২ আনসার সদস্যের প্রত্যেকের নামে সরকার ৫০ শতক থেকে ৭২ শতক পর্যন্ত জমি বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু ৫ আনসার সদস্য ওই সব জমির দখল পেয়েছেন। পাননি ৭ জন আনসার সদস্য ও তাদের মরহুম পরিবার। গার্ড অব অনার প্রদানকারী ১২ আনসার সদস্যকে ২০০৭ সালে টিনের ঘর করে দেয়া হয়। ওইসব টিনে মরিচা পড়ে বর্তমানে ঘরের ভেতরে বৃষ্টির পানি পড়ছে। তাদের টিনের ঘর দ্রুত সংস্কার করা জরুরি বলে তারা মনে করেন। সব মিলিয়ে ১২ আনসার সদস্য ও তাদের পরিবার বর্তমান বাজার মূল্যে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

এতো অভাব অনটনের মধ্যেও তাদের দাবি- মুজিবনগর দিবসকে জাতীয় দিবস ঘোষণা করে প্রতিবছর এদিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক। তারা আরো দাবি করেছেন- মুজিবনগরে ১২ জন আনসার সদস্যের স্থলে ৮ জন আনসার সদস্যের ম্যুরাল তৈরি করা হয়েছে। বাদ পড়েছে মুজিবনগর সরকারের গার্ড অব অনার প্রদানকারী ৪ জনের ম্যুরাল। তাদের দাবি বাকি চারজনের ম্যুরাল সংযোজনসহ প্রত্যেক ম্যুরালে তাদের নামসহ সংক্ষিপ্ত ঠিকানা লিখে রাখা হোক।