মহেশপুরে ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজা আজ থেকে শুরু

মহেশপুর প্রতিনিধি: আজ বৃহস্পতিবার মহেশপুর উপজেলার ফতেপুর বকুলতলা বাজারে পয়লা বোশেখ উপলক্ষে ৩ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী চড়কপূজার মেলা শুরু হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের এই মেলার সভাপতি সাধন কুমার ঘোষ জানান, ইংরেজ শাসন আমল থেকে এই চড়কপূজার উৎসব চলে আসছে। আমাদের বাপ-দাদারাও এই উৎসব পালন করে গেছেন। তাই তাদের দেখাদেখি আমরাও এই উৎসব প্রতি বছর আনান্দের সাথে পালন করে থাকি। মেলা শুরু হয় পয়লা বোশেখ থেকে চলে ৩ দিন। মেলার প্রধান আর্কষণ ২ বোশেখ বিকেলে চড়কপূজা উপলক্ষে হিন্দু ধর্মীয় কিছু লোক সন্ন্যাসী সেজে পিঠে লোহার বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে রসির সাথে বেধে ঘুরানো হয়। এবার একে একে ৭ জন সন্যাসীকে এইভাবে পিঠে বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘুরানো হবে। এবার যারা সন্যাসী হয়েছে তারা হলেন- শ্রী মনা কর্মকার, শ্রী প্রবীন কুমার হালদার, শ্রী ভীম কুমার, আনন্দ কুমার মিন্ত্রি, সাধন বাবু রায়, বিপ্লব কর্মকার ও বাসুদেব বাবু রায়সহ ৭ জন। জায়গা স্বল্পতার কারণে আগের তুলনায় লোক সমাগম অনেক কমে গেছে। তারপরও হাজার হাজার লোকের সমাগম হয়। মেলা উপভোগ করেন নারী-পুরুষ সবাই। চড়ক পাক দেয়া হয় বিকেল ৪টা থেকে আবার সন্ধ্যার আগেই তা শেষ হয়ে যায়।

মেলার সভাপতি আরো জানান, তারা এই চড়ক মেলায় সন্ন্যসীদের পিঠে বড়শি ফুঁটিয়ে চড়ক গাছে তুলে ঘুরানোকে হিন্দু ধর্মীয় চড়কপূজা হিসেবে পালন করে থাকে। তাই প্রতি বছর ফতেপুর বকুলতলা বাজারে এই অনুষ্ঠান পালন হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলা দেখতে আসে। এমনকি পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এই মেলা উপভোগ করতে আসে। এছাড়া মেলায় বিভিন্ন ধরনে দোকান পসরা বসিয়ে মেলাকে জমজমাট করে তোলা হয়।

এলাকাসূত্রে জানা গেছে মেলাটি এর আগে ফতেপুর কপোতাক্ষ নদের পাড়ে অনুষ্ঠিত হতো। বর্তমানে সেখানে আশ্রয়ন প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। ও স্থানে ফতেপুরের বাজারটিও হতো। তৎকালীন জমিদার শ্রী গোপাল চ্যাটার্জির বাবা মেলার জন্য জমি দিয়েছিলেন। তার এক ছেলে অমূল্য কুমার চ্যাটার্জি অভিক্ত বাংলার জজ ছিলেন। বর্তমানে যে স্থানে ফতেপুর বাজার ও মেলা অনুষ্ঠিত হয় সেটি অমূল্য বাবুর মামা হাজারি বাবুর জায়গা।

জানা গেছে ,অমূল্য বাবুর সময়ে মেলাটি খুব জমজমাট হতো। মহেশপুর জমিদারদের সাথে পাল্লাদিয়ে এই মেলা উৎযাপন করা হতো। দেশ ভাগের পর ফতেপুরের প্রভাবশালী হিন্দুরা  ভারতে পাড়ি জমালে স্থানীয় হিন্দুরা মেলাটি দুই জায়গায় শুরু করে। একটি ফতেপুর চাঁদপুর মুচি পাড়ায় (যেখানে বর্তমান কাশেম চেয়াম্যানের বাসা)। অপরটি ফতেপুর বকুল তলা বাজারে। কিন্তু আস্তে আস্তে চাঁদপুর মুচিপাড়ার হিন্দুরা ভারতে চলে গেলে ওই মেলাটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান মেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুভল কর্মকার জানা ফতেপুরে জনবলের অভাবে মেলা উদযাপন করা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। ইতঃপূর্বে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন সহযোগীতা করলেও বর্তমানে সে সহযোগিতা আর পাওয়া যায় না। এছাড়া অল্প কিছু সংখ্যক হিন্দু বর্তমানে আছে আর বাকিরা সবাই ভারতে চলে গেছে। মেলাটি কতো বছর পূর্বে থেকে হয়ে আসেছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রায় ২/৩শ বছর পূর্ব থেকে হয়ে আসছে বলে এমন ধারণা করা হয়। আগে এই মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো চৈত্র মাস বালাকি গানে আয়োজন করা হতো। মেলার ১৫ দিন পূর্ব থেকে হিন্দু সম্প্রদায় নানা ধরনের পূজা-পার্বনের আয়োজন ও আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নিমন্ত্রণপত্র আদান-প্রদান করতো। এতো বছর পরও সাধারণ মানুষের মধ্যে মেলার আগ্রহ কমেনি। ১৮৬৫ সালে আইন করে নৃশংস এ বড়শি বিদ্ধ চড়ক পূজা নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার তখন থেকে এ ধরনের ধর্মীয় আচার বহুল অংশে কমে যায়। তবুও বাংলাদেশের অনেক স্থানে শরীরের রক্ত ঝরানো শৈবভক্ত হিন্দুরা পালন করে চড়ক পূজার অন্যতম প্রধান আচার হিসেবে। এ ধরনের চড়ক পূজা বাংলাদেশের আরো কয়েক স্থানে হয়ে আসছে তার মধ্যে ফতেপুর অন্যতম। ব্রিটিশ আমলে অট্টাদশ শতাব্দির মাঝামাঝির সময়ে ফতেপুর চড়কপূজার পৃষ্ঠপোষক হিসাবে ছিলেন কোলকাতা আদালতের জজ অমূল্য কুমার চট্টোপাধ্যায়, ইঞ্জিনিয়ার নগেন্দ্রনাথ মুখার্জী, ফটিক চন্দ্র মুখার্জী ও দাসু মুখার্জি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর এরা সব ভারতে পাড়ি জমালেও তাদের সেই রেওয়াজ আজ পর্যন্ত বিদ্যমান। বাংলাদেশ স্বাধীনতা উত্তরকালে যারা সন্ন্যাসী হিসেবে চড়ক গাছে পাক খেয়েছেন তারা হলেন অবনিশ কালা, মেগা সন্ন্যাসী, নিতাইপদ মিস্ত্রি, দুলাল চাঁদ মিস্ত্রি। তারা এখন আর কেউ বেঁচে নেই।