ভালোবাসার পয়লা বোশেখ : আজ বাঙালির সার্বজনীন উৎসব

স্টাফ রিপোর্টার: আজ পয়লা বোশেখ। গানের সুরে মন রাঙিয়ে মানুষ বরণ করবে নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৩-কে। গানের সুরে- ‘এসো হে, বৈশাখ এসো এসো/ তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,/ বত্সরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক। দুঃখ-কষ্ট আর আনন্দ তো মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী। কিন্তু মানুষের সম্মিলিত যাত্রা আলোকিত জীবনের দিকে। নতুন বছরে সেই আলোকিত দিন সবার জীবেন বিরাজ করবে- নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে সে প্রার্থনাই করবে সকলে। জাতীয় জীবনে অগ্রগতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতির মাঝেও অশিক্ষা, রাজনৈতিক উত্তেজনা, দমন-পীড়ন জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে। হত্যা, ধর্ষণ, এসব বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের মানুষকে আলোড়িত করেছে। আজ নতুন বছরে সেইসব অন্যায়কে দূরে সরিয়ে শান্তি ও মুক্তির প্রত্যাশাই জানাবে সবাই। কালবোশেখি ঝড় এসে যেন অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে নতুন জীবনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে সে আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ পাবে মানুষের হূদয়ে।

‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর!/তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!/ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কালবোশেখির ঝড়।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতার ভেতর দিয়েই নতুন বছরে সব অপ্রাপ্তি ভুলে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করার সাহস পাবে বাঙালি। ছায়ানট তাই আজ তাদের অনুষ্ঠানে গাইবে মানবতার গান। কবিতার পংক্তিমালায় উচ্চারণ করবে মানবতার জয়গান। মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবার ফুটিয়ে তোলা হবে- মা শিশুর সম্পর্কের মাহাত্ম্যকে। আরো অসংখ্য সংগঠন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের আনাচে-কানাচে বরণ করবে নতুন বছরের প্রথম দিনটিকে।

বাংলা বর্ষের প্রচলন: প্রাচীন যুগে বাংলা সনের প্রথম মাস ছিলো অগ্রহায়ণ। একসময় বাংলায় নববর্ষ পালিত হত আর্তব উত্সব বা ঋতুধর্মী উত্সব হিসাবে। তখন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল কৃষির, কারণ কৃষি কাজ ঋতুনির্ভর। এই ফসল তোলার সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কর আদায়ের সুবিধার জন্য মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। হিজরি চান্দ্র সন ও বাংলা সৌর সনকে ভিত্তি করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। আর তা কার্যকর হয় তার সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে অর্থাত্ ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। প্রথমে এ সন ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিলো, পরে তা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। আর বোশেখ নামটি নেয়া হয়েছিলো নক্ষত্র বিশাখার নাম থেকে, বিশাখা থেকে নাম হলো বৈশাখ। ধীরে ধীরে পয়লা বোশেখ সামাজিক জীবনে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে গেছে। সে সময় বাংলার কৃষকরা চৈত্র মাসের শেষ দিন পর্যন্ত জমিদার, তালুকদার ও অন্যান্য ভূস্বামীদের খাজনা পরিশোধ করতো। পরদিন নববর্ষে ভূস্বামীরা তাদের মিষ্টিমুখ করাতো। এ উপলক্ষে বিভিন্নস্থানে মেলাসহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

পয়লা বোশেখের উত্সবের শুরুটা সেই আকবর আমলেই। এ দিনে তিনি মিলিত হতেন প্রজাদের সাথে। সবার শুভ কামনা করে চারদিকে বিতরণ করা হতো মিষ্টি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আমলে বর্ষবরণ উত্সব চলে আসে জমিদার বাড়ির আঙিনায়। খাজনা আদায়ের মতো একটি রসহীন বিষয়ের সাথে যুক্ত হয় গান-বাজনা, মেলা আর হালখাতা। ‘হালখাতা’ রয়েছে। দেশের ব্যবসায়ী মহলে হালখাতা অনুষ্ঠান মানে নতুন অর্থবছরের হিসাব খোলা।

পয়লা বোশেখ উপলক্ষে আজ জাতীয় ছুটির দিন। সংবাদপত্রগুলোও প্রকাশ করছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সকল প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করা হবে।

নববর্ষ উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। চুয়াডাঙ্গা শিশু একাডেমীর ৩ দিনের কর্মসূচিতে রয়েছে প্রথম দিন আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় শিশু একাডেমীতে চিত্রাংকন প্রতিযোগিতা। বিকেল ৫টায় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিবেশনায় মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। দ্বিতীয় দিন শুক্রবার সকাল ১০টায় শিশু একাডেমীতে হাডুডু, স্কিপিং, হাড়িভাঙা, মোরগ লড়াই, যেমন খুশি তেমন সাজ, স্মৃতি পরিক্ষা ও বালিশ বদল খেলার আয়োজন করা হয়েছে। খেলায় বালক বালিকাসহ শিশুদের মায়েরা অংশগ্রহণ করবে। বিকেল ৪টায় শিশু একাডেমীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তৃতীয় দিন শনিবার সকাল ১০টায় শিশু একাডেমীতে আবৃতি, লোক নৃত্য, জারী গান, লোক সঙ্গীত প্রতিযোগিতা। বিকেল ৪টায় মুক্তমঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিকেল সাড়ে ৫টায় পুরস্কার বিতরণীর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপনী ঘোষণা করা হবে। অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুসের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি থাকবেন জাতীয় সংসদের হুইপ সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন এমপি।

বাংলা নববর্ষ ১৪২৩ উপলক্ষে চুয়াডাঙ্গা জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের উদ্যোগে রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। ক গ্রুপে ৫ম থেকে ৮ম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রচনার বিষয় নববর্ষে বোশেখি মেলা। লিখতে হবে এক হাজার শব্দের মধ্যে। খ গ্রুপে ৯ম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য গ্রামীণ জীবনে বাংলা নববর্ষ। এক হাজার ২ শ শব্দের মধ্যে লিখতে হবে। গ গ্রুপ স্নাতক/স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রী। তাদের রচনার বিষয় বাংলা নববর্ষে সাংস্কৃতিক তাৎপর্য। লিখতে হবে দেড় হাজার শব্দের মধ্যে। ঘ গ্রুপ সর্বসাধারণ, রচনার বিষয় বাঙালির জীবনে বাংলা নববর্ষের প্রেরণা। লিখতে হবে এক হাজার ৮শ শব্দের মধ্যে। রচনা আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারে জমা দিতে হবে। বিস্তারিত জানার জন্য ০১৭১৬৪৭৭১৫৯। প্রেসবিজ্ঞপ্তি।

চুয়াডাঙ্গায় ১৪২৩ বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে ৱ্যালি, আলোচনাসভা ও বাংলা নববর্ষ কাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণ সম্পন্ন হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমির আয়োজনে গতকাল বুধবার সকাল সাড়ে ১০টায় চুয়াডাঙ্গা টাউন ক্লাব ফুটবল মাঠ থেকে ক্রিকেটারদের সমন্বয়ে একটি বর্ণ্যাঢ্য ৱ্যালি শহীদ হাসান চত্বর হয়ে চুয়াডাঙ্গা শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শেষ হয়। ৱ্যালি শেষে আলোচনা সভা, ক্রিকেট কুইজ, ৱ্যাফেল ড্র-সাংস্কৃতিক অনুষ্টান অনুষ্ঠিত হয়। এর পর বাংলা নববর্ষ কাপ ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ণ ও রানার দলের  মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্টানে প্রধান অতিথী হিসেবে উপস্থিত থেকে পুরস্কার বিতরণ করে নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমির কো-চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান জোয়ার্দ্দার মিজাইল। চুয়াডাঙ্গা প্রেসক্লাবের যুগ্ম সম্পাদক বিপুল আশরাফের সভাপতিত্বে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্টানে উপস্থিত ছিলেন জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম মান্নান, নাইটিঙ্গেল ক্রিকেট একাডেমির কোচ অহিদুর রহমান রাজু, টিম কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান আশা, অভিভাবক সদস্য রিচার্ড রহমান, কিংকর দেবনাথ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফরিদুর রহমান ও বিকেএসপির ক্রিকেটার শামীম পারভেজ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ক্রিকেট একাডেমির পরিচালক সাংবাদিক ইসলাম রকিব।

     সরোজগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পুরাতন বর্ষকে বিদায় ও  নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদরের ৫ মাইল বাজার কমিটির উদ্যোগে মেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল বুধবার দুপুরের  প্রধান অতিথি হিসাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ৫ মাইল বাজার কমিটির সভাপতি পদ্মবিলা ইউনিয়নের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান আবু তাহের বিশ্বাস। উপস্থিত ছিলেন সদর থানা গোলাম সারোয়ার হিমু ,লাল্টু জোয়ার্দ্দার, নবনির্বচিত মেম্বার মজিবুল হক, বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ, শঙ্করচন্দ্র ইউনিয়ন আ.লীগের নেতা আযুব আলী, ইউনুস মোল্লা, ৪ নং ওয়ার্ড আ.লীগের সভাপতি মোজাম আলী, সাধারণ সম্পাদক মোক্তার আলী প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ইউপি সদস্য রবকুল ইসলাম।

     মহেশপুর প্রতিনিধি জানিয়েছেন, বুধবার সকালে ফতেপুর গাজীরননেছা নিম্ন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে শুভ বাংলা নববর্ষ পালন উপলক্ষে প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক আব্দুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রস্তুতি সভায় উপস্থিত ছিলেন, ফতেপুর ইউপি সদস্য আশাদুল ইসলাম, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান, শিক্ষক বিউটি খাতুন, রহিমা খাতুন, লাবনী আক্তার, নাছিমা খাতুন প্রমুখ।  এছাড়া উপস্থিত ছিলেন, এলাকার সুধীজন, অভিভাবক, ছাত্রী সহ এলাকাবাসী। উল্লেখ্য, ১ বোশেখখ উপলক্ষে স্কুল ময়দানে দিনের কর্মসূচি হিসাবে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বোশেখি ৱ্যালি, পান্তা আপ্যায়ন, খেলাধুলা পর্বে বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ। এছাড়া বিকালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে আগত শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করবেন, সঙ্গীত শিল্পী সাবরিনা জামান তুন্নি, খুদে গানরাজ ডিও দত্ত, মডেল তারকা শাহিনা আক্তার পুষ্প ও সোহা পারভীন। আরো সঙ্গীত পরিবেশন করবেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সজীব খান ও তারিক আহম্মেদ।